-রাজিব আহমেদ
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের সীমান্তবর্তী জনপদ চুয়াডাঙ্গার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য। চুয়াডাঙ্গা ছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। যারা মনে করেন-এই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রমাণ নেই, তারা আসলে বই-বিমুখ; পড়াশোনার ধারে-কাছেও নেই! যদি থাকতেন, তাহলে ঠিকই খবর রাখতেন- চুয়াডাঙ্গা যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী ছিল, ইতিহাসের পাতায় তার যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ আছে, কালের অতলে কিছুই হারিয়ে যায়নি। সেই সব তথ্য-প্রমাণ আমার গবেষণা-গ্রন্থ ‘চুয়াডাঙ্গা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’-এ (পৃষ্ঠা ১১৭-১১৯) তুলে ধরেছি; সংশ্লিষ্ট দলিল-দস্তাবেজ-এর ছবিও ছেপেছি (এই জেলার রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃবৃন্দ সেই বই কোনোদিন খুলে দেখেছেন কিনা সন্দেহ, পড়া তো দূরের কথা)! তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই বলছি- ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস (মানে স্বাধীনতা ঘোষণার দিন) থেকে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে প্রবাসী সরকার শপথগ্রহণ পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা ছিল বাংলাদেশের রাজধানী। শুধু তাই নয়, যুদ্ধকালীন বাংলাদেশে রেডক্রস (বর্তমানে রেডক্রিসেন্ট)-এর আনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের সূচনাও এই চুয়াডাঙ্গার বুকে।
সমগ্র বাংলাদেশ নামক ভূখণ্ডে যত রেলপথ আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে পুরানো রেললাইন কলকাতা-রানাঘাট হয়ে দর্শনা দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত গেছে। এখন সেটি একমাত্র আর্ন্তজাতিক রেলরুট আর চুয়াডাঙ্গা এই ভূখন্ডের প্রথম রেলস্টেশন।
এই অঞ্চল একদা নীলকুঠিতে ভরপুর ছিল। নীলবিদ্রোহের বড় বড় ঘটনাগুলোও ঘটেছে চুয়াডাঙ্গার মাটিতে (আগ্রহীরা গতিধারা প্রকাশিত ‘বাংলায় নীলচাষ ও নীলবিদ্রোহের ইতিহাস’ বইটি পড়তে পারেন)। বিদ্রোহীরা নীলচাষ ঠেকাতে পুরো অঞ্চল খেজুর গাছ লাগিয়ে ভরে ফেলেছিল। সেই বিবেচনায় খেজুরগাছও এই জেলার প্রতিনিধিত্ব করে। এশিয়ার বৃহত্তম দত্তনগর কৃষিখামার-এর কিছু অংশ জীবননগর উপজেলার অন্তর্গত। কৃষিপ্রধান চুয়াডাঙ্গা জেলা এই মুহূর্তে বিখ্যাত পান ও ভুট্টা চাষের জন্য। আরো বিখ্যাত ব্ল্যাক-বেঙ্গল গোট বা বিশেষ জাত-এর কালো রঙের ছাগলের জন্যও। এমনকি চুয়াডাঙ্গায় উৎপাদিত পণ্য হিসেবে বঙ্গজ বিস্কুট সারাদেশে বেশ জনপ্রিয়!
মাথাভাঙ্গা নদ (যার অপর নাম হাবেলি বা হাউলে) ছিল অত্রাঞ্চলের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। আর এখানে রাজত্ব করতেন অসংখ্য ক্ষুদ্র জমিদার। আজও অনেক জমিদার বাড়ি কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। অনেকেই জানেন না যে, লালন সাঁইয়ের মৃত্যুর পর ছেউরিয়াতে অনুসারীদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়। স্বার্থের দ্বন্দ্বে সবাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, কেউ কেউ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তখন লালন অনুসারীদের মধ্যে যারা প্রকৃত সাধক ও সুরের ধারাবাহক ছিলেন, তাঁরা ছেউরিয়া ছেড়ে আলমডাঙ্গা অঞ্চলে আশ্রয় নেন। লালনের গান এক সময় ধারণ করে রেখেছিল শুধু আলমডাঙ্গা জনপদ। সেই থেকে এখন পর্যন্ত চুয়াডাঙ্গা বাউল প্রধান এলাকা হিসেবে খ্যাত। আলমডাঙ্গার জাঁহাপুর গ্রামের বাউল সাধক খোদাবক্স সাঁই এই জেলার একমাত্র একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে বহু সাধক ও শিল্পী নীরবে-নিভৃতে তাঁদের অস্তিত্ব ও সাধনা টিকিয়ে রেখেছেন।
ইসলাম প্রচারেও চুয়াডাঙ্গা ছিল অগ্রগণ্য। আলমডাঙ্গার ঘোলদাড়ি মসজিদটি বৃহত্তর কুষ্টিয়ার প্রথম মসজিদ। জেলা জুড়ে এখনো টিকে আছে নাম জানা বা না জানা অসংখ্য পীর-ফকির-সাধুর আস্তানা। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং গোয়েন্দা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের জন্মভূমিও এই চুয়াডাঙ্গা।
১৮৮০ সালে ব্রিটেনের মহারানী ভিক্টোরিয়ার ক্ষমতারোহনের হীরক জয়ন্তী উপলক্ষে ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে স্মারক ভবন তৈরি করে দেওয়া হয়। চুয়াডাঙ্গা ভিক্টোরিয়া জুবিলি (সংক্ষেপে ভি. জে.) হাইস্কুল আজও সেই স্মৃতি ধারণ করে আছে। আরেকটি ঐতিহাসিক শিক্ষায়তন হচ্ছে হাজার দুয়ারি স্কুল (নাটুদহ উচ্চ বিদ্যালয়)।
হাল আমলে চুয়াডাঙ্গার বিখ্যাত আট কবর ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত ছিল অনালোচিত ও অবহেলিত। আমি আর বন্ধুবর কবি জাহিদুল ইসলাম (নির্বাহী পরিচালক, রিসো) প্রথম যখন গ্রামের পর গ্রাম আর মেঠোপথে হেঁটে আট কবর খুঁজে বের করি, তখন তার অবস্থান ছিল চষাজমির এক প্রান্তে। ওখানে রাস্তাঘাট বলতে কিছুই ছিল না। ১৯৭১ সালে শহীদদের লাশ দাফনকারী কিতাব হালসোনা তখনো বেঁচেছিলেন। তিনিই আমাদের দু’জনকে আট কবরের কাছে নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দেন।
সেই আট কবর নিয়ে ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম গবেষণা-গ্রন্থ ‘সম্মুখ সমরে’-এর একটি কপি গিয়ে পৌঁছুল তৎকালীন এল.জি.ই.ডি’র প্রধান প্রকৌশলী জনাব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক-এর হাতে। তিনি মেহেরপুর এল.জি.ই.ডি-কে দায়িত্ব দিয়ে আট কবরের উপর সমাধিসৌধটি তৈরি করান। এখন প্রতিবছর ৫ আগস্ট আট কবরে ঘটা করে স্থানীয় শহীদ দিবস পালিত হয়, জীবিত মুক্তিযোদ্ধারা সমবেত হন; কিন্তু যে রাজিব আহমেদের বই লেখার সুবাদে জনাব কামরুল ইসলাম সিদ্দিক এতোকিছু করলেন- সে কথা মুক্তিযোদ্ধা আলী আজগার ফটিক ছাড়া আর কেউ স্মরণ করেন না (আট কবরের পাশে স্থাপিত প্রথম নামফলকে তথ্যসূত্র হিসেবে আমার নাম উল্লেখ ছিল, পরে সেটাও সরিয়ে ফেলা হয়)!