নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে বিদ্যুতের সব্বোর্চ উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে। বিদ্যুত ও জ্বালানী মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বার বার বলা হচ্ছে অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বিদ্যুত উৎপাদনে রেকর্ড গড়ছে। কিন্তু তারপরও চুয়াডাঙ্গায় চলছে বিদ্যুতের লোডশেডিং। পাশাপাশি লো-ভোল্টেজের সংকট তো আছেই। রমজানের আগে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছিলেন রমজান মাসে সেহরী, তারাবি বা ইফতারির সময়ে কোন লোডশেডিং হবে না। এমন প্রতিশ্রুতিরও ব্যতয় ঘটছে চুয়াডাঙ্গায়। গত কয়েকদিন ধরেই চুয়াডাঙ্গায় দিনে রাতে চলছে লোডশেডিং। এমনকি ইফতারি, সেহরী ও তারাবির নামাজের সময় চালানো হচ্ছে লোডশেডিং। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রয়া ব্যক্ত করছেন বিদ্যুতের গ্রাহক সাধারণরা।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গায় বিদ্যুত সরবরাহের জন্য শহরে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানী লি: ও গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জন্য পল্লী বিদ্যুত সমিতি বিদ্যুত সরবরাহ করে থাকে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, চুয়াডাঙ্গা শহরে ৫টি ফিডারের মাধ্যমে বিদ্যুত সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের আওতাধীন গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে পল্লী বিদুতের গ্রাহক রয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার।
চুয়াডাঙ্গা শহরের গ্রাহকরা বলছেন, কিছুদিন আগেও চুয়াডাঙ্গা শহরে বিদ্যুত ব্যবস্থা ছিল সন্তোষজনক। কিন্তু বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী মো: ময়নুদ্দীনের যোগদানের পর থেকেই ক্রমেই অবনতি হতে থাকে পরিস্থিতির। শুরু হয় লোডশেডিং নামক যন্ত্রণা। পাশাপাশি লোভেল্টেজের সংকট তো আছেই।
চুয়াডাঙ্গা শহরের বাগান পাড়ার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন জানান, তিনি হাজরাহাটি ফিডারের আওতাভুক্ত গ্রাহক। তার দাবি দেশে রেকর্ড বিদ্যুত উৎপাদন হলেও চুয়াডাঙ্গাতে অজানা কারণে লোডশেডিং দেওয়া হচ্ছে। দিনে রাতে সমান তালে চালানো হচ্ছে লোডশেডিং।
শহরের গুলশানপাড়ার বাসিন্দা রহমত উল্লাহ জানান, সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জানানো হয়েছিল পবিত্র রমজান মাসে ইফতারী, সেহরী ও তারাবীর নামাজের সময় কোন লোডশেডিং হবে না। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার ক্ষেত্রে মানা হচ্ছে না এ নিদের্শনা।
বিদ্যুতের এমন পরিস্থিতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শহরের বড় বাজার পাড়ার গ্রাহক মমতাজ পারভীন। তিনি জানান বিদ্যুতের এমন বেহাল দশার কারণে পৌরসভার সরবরাহকৃত পানিও ঠিকমত পাচ্ছিনা আমরা। এমনিতেই লোডশেডিং তার উপর লো-ভোল্টেজের কারণে বাসা বাড়ির ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী পুড়ে নষ্ট হচ্ছে। তার অভিযোগ এমনিতেই বিদ্যুত পাচ্ছি না কিন্তু বিলও যথারীতিই করা হচ্ছে।
এ তো গেলো শহরের সংকটের কথা। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিদ্যুত গ্রাহকদের দূর্ভোগ আরও বেশি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘন্টার পর ঘন্টা চালানো হচ্ছে লোডশেডিং। রাতেও চলছে না ফ্যান।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা শরীফ উদ্দীন জানান, দিনে তো ঠিকমত বিদ্যুত পাইনা। রাতে যে একটু ঘুমাবো তাও হচ্ছে না। লো-ভোল্টেজের কারণে সিলিং ফ্যানও ঠিকমত চলছে না।
সরোজগঞ্জের বোয়ালিয়া গ্রামের বিদ্যুত গ্রাহক রফিকুল ইসলাম জানান, প্রচ- তাপদাহে চুয়াডাঙ্গা পুড়ছে। অথচ আমরা বিদ্যুত পাচ্ছিনা। সারাদিন পরিশ্রম করে বিদ্যুতের বেহাল দশায় রাতে ঠিকমত ঘুমাতেও পারছি না।
অনুসন্ধান বলছে, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের ৩৬ হাজার গ্রাহকের জন্য বিদ্যুতের প্রয়োজন ২২ মেগওয়াট বিদ্যুত। আর পল্লী বিদ্যুতের ৪ লাখ ৫৪ হাজার গ্রাহকের জন্য দরকার ৭৯ মেগওয়াট বিদ্যুত।
ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানী লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: ময়নুদ্দিন আকাশ খবরকে জানান, বিদ্যুতের নিয়ম অনুযায়ী বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পিকআওয়ার ধরা হয়। সেই হিসাবে আমাদের ৩৬ হাজার গ্রাহকের জন্য প্রয়োজন হয় ২২ মেগওয়াট বিদ্যুত। কিন্তু আমাদের জাফরপুর ১ লাখ ৩৩ কেভির গ্রিড সাব স্টেশন থেকে চাহিদার ৩/৪ মেগওয়াট কম দেওয়া হচ্ছে। যার কারণে লো-ভোল্টেজ ও লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছি।
দেশে বিদ্যুতের রেকর্ড উৎপাদনের পরও কোন চাহিদা মত বিদ্যুত পাচ্ছেন না কেন এমন প্রশ্ন করা হলে প্রকৌশলী ময়নুদ্দিন বলেন এটি গ্রিড সাব স্টেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ভাল বলতে পারবেন।
অভিন্ন কথা বলেন, মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুতের চুয়াডাঙ্গা জোনের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) আয়েশা সিদ্দিকী। তিনি জানান, পল্লী বিদ্যুতের চুয়াডাঙ্গা জেলার গ্রাহক রয়েছে ৪ লাখ ৫৪ হাজার। অথচ আমরা তাদের ঠিকমত বিদ্যুত দিতে পারছিনা। তার দাবি, চাহিদার চেয়ে প্রাপ্তির সমন্বয় না থাকায় অনিচ্ছা থাকা সত্বেও আমাদেরকে লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।
কথা হয় চুয়াডাঙ্গা জাফরপুর ১ লাখ ৩৩ কেভির গ্রিড সাব স্টেশনের সহকারী প্রকৌশলী সুদীপ্ত কুমার বিশ্বাসের সাথে। তিনি আকাশ খবরকে জানান, ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্টিবিউশন কোম্পানী লিমিটেড ও পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকের জন্য বিদ্যুত দরকার ১০১ মেগওয়াট। কিন্তু সেটিতে ব্যতয় ঘটছে। দেশে বিদ্যুতের রেকর্ড উৎপাদনের পরও কেন বিপর্যয় হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে সুদীপ্ত কুমার বলেন, জাতীয় গ্রিডে রেকর্ড উৎপাদন হচ্ছে ঠিকই। তবে সেটি গ্রিড থেকে আসতে কিছুটা ড্রপ হচ্ছে। তিনি দাবি করেন জাতীয় গ্রিড থেকে কুষ্টিয়ার ভেড়ামেরা গ্রিড হয়ে আমাদের গ্রিডে বিদ্যুত আসে। একটি গ্রিড থেকে আরেকটি গ্রিডের দুরত্ব অনেক বেশি হওয়ায় ড্রপ হয়ে মেগওয়াট কমে যাচ্ছে। যার কারণে প্রাপ্ত বিদ্যুত থেকে কম পেয়ে রেসিও অনুযায়ী পিডিবি ও পল্লী বিদ্যুতকে ভাগ করে বিদ্যুত দেওয়া হচ্ছে।
ভোক্তাদের সংগঠন ক্যাবের চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি এ্যাড মানিক আকবর জানান, যখন দেশে রেকর্ড বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে তখন জাফরপুর গ্রিডের সহকারী প্রকৌশলী সুদীপ্ত কুমার বিশ্বাসের এমন কথা অযৌক্তিক। তিনি জানান, যদি এক গ্রিড থেকে অন্য গ্রিডে বিদ্যুত পৌছাতে ড্রপ হয়ে মেগওয়াট কমে যায়, তাহলে জাতীয় গ্রিডকে বলে চাহিদার কয়েক মেগওয়াট বিদ্যুত বেশি ডিমান্ড দিলেই তো সংকটের সমাধান হয়ে যায়।