নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনাভাইরাস এখন বিশ্বের ১ নম্বর গণশত্রু। এই ভাইরাসের একমাত্র লক্ষ্য মানুষকে খুঁজে খুঁজে আক্রান্ত করা। উপযুক্ত পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি দিন দিন আরও খারাপের দিকেই যাবে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনলাইন ব্রিফিংয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস এসব কথা বলেছেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের মতো সত্যজিৎ রায় মহাশয়ও আমাদের গণশত্রু চিনিয়েছেন তাঁর প্রখ্যাত একটি বাংলা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। তবে কি আমরা বঙ্গবন্ধুর মতো গণবন্ধু না পেয়ে শুধুই গণশত্রু পাবো।
জেলার সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, আগে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সাধারণ মানুষের বিপদে-আপদে এগিয়ে আসতেন। পঞ্চাশের দশকে যখন দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছিল, তখন আওয়ামী লীগের তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ভুখা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনী প্রচার স্থগিত রেখে ছুটে গেছে উপকূলের বিপন্ন মানুষগুলোকে বাঁচাতে। তখন যোগাযোগব্যবস্থা এত উন্নত ছিল না। তারপরও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা সেখানে গেছেন। কেবল দলের নেতা-কর্মী নন, গেছেন ছাত্র-তরুণেরা, সংস্কৃতিসেবীরা, নারী সংগঠনের নেত্রীরা। স্বাধীনতার পর ১৯৮৮ সালের বন্যার সময় দেখেছি, বহু স্থানে ছাত্র ও যুব সংগঠনের উদ্যোগে রুটি তৈরি করা হয়েছিল। বিভিন্ন দলের নেতারা বন্যা উপদ্রুত এলাকা পরিদর্শন করে সাধ্যমতো গরিব মানুষকে সহায়তা করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তখনকার রাজনৈতিক নেতাদের দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা ছিল। যা বর্তমানে তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ সামাল দিতে সরকারের দেওয়া লকডাউনে যখন চুয়াডাঙ্গার জনজীবন বিপর্যস্ত, তখন দুই প্রধান দলের নেতা-কর্মীদের নির্লিপ্ততা নিয়ে ক্ষোভ ছড়াচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চোখ রাখলেই তার পরিস্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিদিনই চুয়াডাঙ্গার মানুষ করোনার ভয়াল থাবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। মৃত্যুর সংখ্যাতেও রেকর্ড ছুঁতে যাচ্ছে। মানুষ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা পাচ্ছে না। অক্সিজেনের জন্য চলছে হাহাকার। বাড়িতে খাবার নেই, শতশত মানুষ বেকার হতে বসেছেন। অথচ চুয়াডাঙ্গার রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা এসব অসহায় মানুষের পাশে নেই। নেই সমাজের বিত্তশালীরা। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়াচ্ছে জনমনে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের ভ্যান চালক রহমত মন্ডলের ক্ষোভ ভোটের সময় বিভিন্ন নেতাদের দেখা যায়, তারা নাকি আামদের জন্য রাজনীতি করেন, আমাদের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করেন। অথচ তারা এখন কোথায়?
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পলাশপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হচ্ছে কিছুটা সহায়তা করার। তা করা হচ্ছে। কিন্তু চুয়াডাঙ্গার রাজনীতিবিদদের কি কোন দায়বদ্ধতা নেই। ভোটের সময় তো কতজনকেই দেখা যায় তারা এখন কোথায়? কেন তাদেরকে এখন অসহায় মানুষদের পাশে দেখা যাচ্ছেনা।
চুয়াডাঙ্গা শহরতলীর দৌলতদিয়াড় গ্রামের পরিবহন শ্রমিক সবুজ আলি জানান, টানা লকডাউনে চরম অমানবিক জীবন যাপন করছি। কাজ নাই তাই আমরা অসহায়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ কেজি চাল ডালসহ কিছু খাবার দিয়েছিল তা শেষ। বাড়িতে খাবার নেই। অথচ ৬ জনের সংসার। কি করবো কিছুই মাথায় আসছেনা।
শহরের গুলশানপাড়ার বাসিন্দা আফরোজা খাতুন জানান, প্রতিদিনই করোনা আক্রান্ত হয়ে মানুষ মরছে। হাসপাতালে সেবা বলতে কিছু নেই। অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরছে, নেই আইসিইউ। অথচ আমাদের ভাগ্য নির্ধারক রাজনীতিবিদরা এ বিষয়ে কেউ এগিয়ে আসছে না।
অথচ, চুয়াডাঙ্গা জেলায় ২ জন সংসদ সদস্য আছেন। একজন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, ৪ জন মেয়র আছেন। ৪ জন উপজেলা চেয়ারম্যান, ৪ জন ভাইস চেয়ারম্যান। আছেন ৪৩টি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পরিষদ সদস্য আর সাবেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিতো আছেনই। অথচ এই দুঃসময়ে তাঁদের কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না।
চুয়াডাঙ্গা সাহিত্য পরিষদের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক মুন্সি জানান, মানুষ কষ্টে আছে, তাতে এই শ্রেণির মানুষদের কিছুই যায় আসে না। কোভিড-১৯ মহামারিতে এই শ্রেণি আছে বহাল তবিয়তে। এদের খাবার, চিকিৎসা এবং মৌলিক সুবিধাদি সবই ঠিক আছে। সে কারণে, এরা ক্ষুধার কষ্ট যেমনি বোঝে না, তেমনি এদের কোনো দায়িত্ব আছে সেটাও মনে করে না। শুধু নিজেদের সুরক্ষা নিয়ে এরা অতি ব্যস্ত।
তবে করোনার এমন পরিস্থিতিতে সবাই যে ঘরে বসে আছে তেমনটিও নয়। চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ করোনা সুরক্ষায় সাধারণ মানুষের মাঝে মাস্ক ও স্যানিটাইজার বিতরণ করেছেন। ব্যক্তিগত জায়গা থেকেও তিনি খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে করোনা ওয়ার্ডে স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজী আলী আজগর টগর ইতোমধ্যে তার নির্বাচনী এলাকা ছাড়াও জেলা হাসাপাতালে করোনা রোগীদের জন্য একটি হাই-ফ্লো ন্যাজেল ক্যানোলা অক্সিজেন মেশিন নিজ অর্থায়নে প্রদান করেছেন। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে দিয়েছেন অক্সিজেনসহ সহ যাবতীয় সরঞ্জাম। নিজ উদ্যোগে অসহায় মানুষদের পাশে খাদ্য সহায়তাও বিতরণ করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি জেলার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মোল্লা মটরস নিজ অর্থায়নে একটি হাই-ফ্লো ন্যাজেল ক্যানোলা অক্সিজেন মেশিন প্রদান করেছেন। অবশ্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বিপন্ন জনগণের পাশে তেমন না দাঁড়ালেও সচেতন মানুষ কিন্তু এগিয়ে আসছেন। চুয়াডাঙ্গা জেলা হাসপাতালে আইসিইউ নির্মাণের জন্য অরিন্দম সাংস্কৃতিক গোষ্টি এবং ফেসবুক ভিত্তিক সামাজিক সংগঠন নেটওয়ার্ক চুয়াডাঙ্গা তহবিল গঠন করতে ইতিমধ্যে মাঠে নেমেছেন।