নিজস্ব প্রতিবেদক:
ভাল নেই চুয়াডাঙ্গা। ভাল নেই চুয়াডাঙ্গার মানুষ। প্রতিদিনই একের পর এক প্রিয় মুখগুলো করোনার ভয়াল গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। প্রায় প্রতিটি নামাজের ওয়াক্তে মানুষের মৃত্যুর খবরে গুমরে কাঁদছে মানুষ। তবুও প্রিয় মানুষটির মুখটি দেখতে যেতে সাহস করছেন না অনেকে। কেউ কি কখনো ভেবেছিল হঠাৎ এমন করে উল্টে যাবে জীবনের চাকা? অনিশ্চয়তার জালে জড়িয়ে পড়বে লাখ লাখ মানুষ। কোথায় হবে এর শেষ পরিণতি, কারও জানা নেই।
সুধিজনেরা বলছেন, ভাবতেই সবকিছু যেন ওলটপালট হয়ে যায়। মনে হয়, চিরদিনের জন্য পৃথিবীটা আঁধারে ঢেকে গেছে; আর বুঝি কোনো দিন আলোর মুখ দেখব না। এই বিপর্যয়ের দ্রæত সমাধান জরুরি। অন্যথায় সামনে আরও অন্ধকার অপেক্ষা করছে। সঙ্গে যোগ হবে মহাবিপদ।
চুয়াডাঙ্গার করোনা পরিস্থিতি যতটা ভয়াবহ তার চেয়ে ভয়াবহ চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগের বেহাল চিত্র ও অব্যবস্থাপনা। যদিও জেলার সিভিল সার্জন এএসএম মারুফ হাসান তা মানতে নারাজ। তার দাবি করোনা বিশেষায়িত করোনা হাসপাতালে সার্বক্ষুনিক ১০ জন চিকিৎসক ও ৩০ জন নার্স নাকি দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলছেন সব ঠিকঠাক মতই চলছে। অর্থচ পর্যবেক্ষণ বলছে ২ নার্স ও ১ ডাক্তারকে দিয়ে চুয়াডাঙ্গার এই করোনা বিশেষায়িত হাসপাতাল চলছে। সেখানে আইসোলেশন ওয়ার্ডে যখন তখন করোনা ওয়ার্ডে ঢুকছে বার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। মোট কথা কোন নিয়ন্ত্রণ নেই চুয়াডাঙ্গা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। খাবার ও ওষুধের যোগান নেই। অক্সিজেন নেই, আইসিইউ নেই।
এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএমএ এর সভাপতি প্রবীণ চিকিৎসক ডাক্তার মার্টিন হীরক চৌধুরী তাঁর ফেইসবুককে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট জরুরী ভিত্তিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহ করার জন্য তার স্ট্যাটাসে অনুরোধ করেছেন। তার মতে চুয়াডাঙ্গার করোনা পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। শ্বাসকষ্ট শুরু হলে রোগীর প্রয়োজন অক্সিজেন যা হাসপাতালে নেই।
হাসপাতালে কর্তব্যরত একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতা নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন ” অনেক অসহায় বোধ করছি, প্রতিদিনই নতুন নতুন রোগী আসছে। তাদের স্যাচুরেশন খুব খারাপ। তার মতে যেখানে রোগীর শরীরে অক্সিজেন সার্কুলেশন ৯০ এর উপরে থাকার কথা,সেখানে ৩৫, ৪০, ৬০, ৭০, ৭৫- এই অবস্থা পাওয়া যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ হাসপাতালে আমাদের সামনেই কিছুক্ষণ থেকে তারপর মারা যাচ্ছে।
করোনা আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিনই মৃত্যুর তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে, চুয়াডাঙ্গা জেলায় এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৯৪৫ জন। বর্তমানে এ জেলায় সক্রিয় রোগীর মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১৩৮ জন, বাসায় আইসোলেশনে আছেন ১ হাজার ৩৪১ জন ও রেফার্ড করা হয়েছে ৩ জনকে। এ পর্যন্ত মোট ১৫ হাজার ১৮১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। পরীক্ষার রিপোর্ট পাওয়া গেছে ১৪ হাজার ৫৩৩ জনের। এছাড়া এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে ১১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে জেলায় মারা গেছেন ১০১ জন। আর জেলার বাইরে বিভিন্ন স্থানে মারা গেছেন ১৬ জন। যা রীতিমত উদ্বেগ জনক।
অনুসন্ধান বলছে, চুয়াডাঙ্গায় করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতালেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) নেই। এক বছরের বেশি সময় ধরে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা আশ্বাস দিয়েও এখন পর্যন্ত জেলায় কোনো আইসিইউ চালু করা যায়নি। আর কত দিনে আইসিইউ চালু হবে, তা কেউই বলতে পারছেন না।
জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয় স‚ত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের স¤প্রসারিত ১৫০ শয্যার ভবনসহ ১৯৫ শয্যা এবং তিন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও ৫৫টি শয্যা প্রস্তত রাখা হয়েছে। এসব শয্যার বিপরীতে ৩০ জন চিকিৎসক ও ২৭ জন নার্স সংযুক্ত রাখা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে আরও ১০ জন চিকিৎসককে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। যা শুধু সিভিল সার্জনের কথা ও কাগজ কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
চুয়াডাঙ্গা পৌর ডিগ্রী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো: শাহাজান আলি বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে তার উদ্বেগ উৎকন্ঠার কথা জানান। তিনি বলেন, কোন দিকে যাবে চুয়াডাঙ্গার করোনা পরিস্থিতি? যদি করোনা মৃত্যু হার অন্যজেলাগুলোকে ডিঙ্গিয়ে যায়, তাহলে কি মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, নবগঙ্গাসহ সব নদীতে ভাসবে অসংখ্য স্বজনের লাস? দিতে হবে গণকবর? গণদাহ? বাড়িতে পড়ে থাকবে কি মৃত লাশ? আসলে সবই নির্ভর করছে মানুষের উপর, তারা কতটা সচেতন ভাবে মোকাবিলা করতে পারবে করোনার ক্রমবর্ধমান গতি আর সরকারই বা কতটা পারবে স্বাস্থ্য সেবা অব্যাহত রাখতে?