দুপুর গড়িয়ে বিকেল আসি আসি করছে। গাছপালায় ঘেরা বাড়িটাই মনে হচ্ছে সন্ধ্যা একটু আগেই এসে গেল! আমি একটা বই পড়ছিলাম। বইটা রেখে দোতলায় গেলাম। দোতলায় মোট তিনটা রুম। বড় মেয়ে, ছোট মেয়ে ও মায়ের জন্য আলাদা আলাদা রুম। দোতলায় উঠেই ছোট মেয়ে অরোনার রুম, ওকে পেলাম না। একটু এগিয়ে বড় মেয়ে রোয়েনার রুমে, দু’জনকে একসঙ্গে পেলাম। ওরা গল্প করছে। আমি চুপচাপ ওদের পাশে গিয়ে বসলাম। ওরা কথাবার্তা চালিয়ে গেল। আমি শুনছি। হঠাৎ ছোট মেয়ে অরোনা বললো, ‘‘আব্বু, কিছু বলবে?’’ ‘‘না, তেমন কিছু না, চলো মাঠ থেকে ঘুরে আসি। আমাদের বড় জমিটা দেখে আসি’’- আমি প্রস্তাব করলাম। ওরা তাৎক্ষণিকভাবে বেরিয়ে পড়লো। পথে নেমে অরোনা জিজ্ঞেস করলো, ‘‘তুমি চুপচাপ কেন? কোন কথা বলছো না।’’ আমি বললাম, ‘‘তোমাদের শুনছিলাম।’’ যাকে বলে ‘কোয়ালিটি লিসেনিং’ বা ‘একটিভ লিসেনিং’। অরোনা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো- ‘‘তোমার মতলব তো একটা আছেই! তুমি কি লিসেনিং নিয়ে কথা শুরু করতে চাচ্ছো?’’ ‘‘তোমরা যদি শুনতে চাও, তাহলে বলি। বড় মেয়ে রোয়েনা বললো- ‘ঠিক আছে, হাঁটতে হাঁটতে তোমার কথা শুনি।’’
একবার মি. জনের এক নারী সহকর্মী তাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘‘মি. জন, তোমার সাথে আমরা যখন কথা বলি, তখন তুমি রুমের এদিক-ওদিক কি দেখ? আমাদের কথা শোন কিনা- তা আমরা বুঝতে পারি না।’’ এই কথা শুনে মি. জন চিন্তায় পড়ে যায়। এতদিন সে জানতো যে- সে একজন ভালো শ্রোতা। মি. জন ওই নারীর বস সত্ত্বেও ক্ষমা চাইলেন এবং তার টেবিলের সামনের ওয়ালে ‘এল’ ইংরেজিতে লিখে রাখলেন যার অর্থ শোনা। কিছুদিন পর আরও একটা ‘এল’ ইংরেজিতে লিখলেন যার অর্থ ‘লুক’। অর্থাৎ তিনি ‘তাকিয়ে শোনা’ শুরু করলেন। এতে করে অফিসে তার লিডারশিপ বহুগুণে তীক্ষè হয়।
প্রবাদে আছে- ‘আগে শোনা, পরে বলা।’ কিন্তু মানুষ তা জেনেও মানে না। স্টিভেন বি. স্যাম্পল বলেন সাধারণ মানুষ তিনটি ভুল করে- ‘‘১. সে নিজেকে ভালো ড্রাইভার মনে করে, ২. সে খুব মানবিক একটা মানুষ ও ৩. সে একজন ভালো শ্রোতা ।” একটা গবেষণায় দেখা গেছে- আমাদেরকে যা বলা হয়, তার অর্ধেক আমরা শুনি। যা আমাদের শোনা উচিত, তার অর্ধেক শুনি। যা শুনি তার অর্ধেক বুঝি। যা বুঝি তার অর্ধেক বিশ্বাস করি। যা বিশ্বাস করি, তার অর্ধেক স্মরণ রাখি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কোয়ালিটি লিসেনিং= শোনা+শেখা+পালন করা/মানা। এভাবে একজন লিডার হাত ছোয়ার আগেই হৃদয় ছুয়ে দিতে পারেন। একজন ভালো লিডার ছোট্ট একটা ইস্যুকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে পারেন- শুধুমাত্র মনোযোগ দিয়ে শোনার মাধ্যমে। নেতা তখনই মস্তবড় ভুল করে বসেন- যখন তিনি শোনার চেয়ে বেশি বলে থাকেন। কর্মীর অনেক কথা বলার থাকে। সে তার কথা বলতে চায়, বলতে পারার মধ্যে নিজেকে সম্মানীত মনে করে এবং তৃপ্তি পায়। ব্রায়ান ট্রেসি বলেন ‘‘শোনা আস্থা তৈরি করে এবং এটা স্থায়ী সম্পর্কের ভিত্তি।’’ শোনার মধ্য দিয়েই কর্মীর প্রতি লিডারের মনোযোগ প্রকাশ পায়। লিডারের যেমন অনেক কথা বলার থাকে কর্মীর অনেক কথা থাকতে পারে।
রোয়েনা বললো, ‘‘একটা শিশু যখন বড় হতে শুরু করে- সে তো পড়তে পারে না। সেই শিশুটি সবকিছু শেখে- দেখা এবং শোনার মাধ্যমে। আমাদের বাংলা ভাষার মতো একটা কঠিন ভাষা শিশুটি শিখে ফেলে শোনার মাধ্যমে। ছোট মেয়ে অরোনা বললো, ‘‘ সেদিন ফেসবুকে লেখা দেখলাম- যুদ্ধ না করে যদি জয়ী হওয়া যায়, তাহলে যুদ্ধ কেন? অনুরূপভাবে আমরা কি বলতে পারি না- শুনেই যদি জয়ী হওয়া যায়, তাহলে বলে লাভ কি।’’ আমি বললাম- ল্যারি কিং নামক একজন বিখ্যাত টক-শো এক্সপার্ট বলেন, আমি প্রতি সকালে নিজেকে বলি- আমি যা বলি তা থেকে আমার কিছুই শেখা হয় না; তাইতো আমি প্রতিদিন শিখছি- অবশ্যই তা শোনার মাধ্যমে।’’
আমরা সবুজ ঘাসের উপর দিয়ে হাঁটছি- নরম রোদ সারাটা মাঠ ঘিরে রেখেছে, সবুজ ফসল গুলো যেন তাদের আঙিনায় আমাদের অভিবাদন জানাচ্ছে। (চলবে)
মোঃ বশির আহম্মেদ
একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মী