নিজস্ব প্রতিবেদক:
রেহানা বেগম স্বামী ও দুটি সন্তান নিয়ে বসবাস করেন পটুয়াখালীর কুয়াকাটা পৌর এলাকার জেলে পল্লী আশি ঘর কলোনিতে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের তাণ্ডবে ছোট্ট ঘরটি উড়ে গেছে। ভিটাও ধসে গেছে পানির তোড়ে। রেহানার মতো জেলে পল্লীর পুরোটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখানের অন্তত দুইশ জেলে পরিবার এখন একেবারেই উদ্বাস্তু। খোলা আকাশের নিচে জীবন কাটছে তাদের।
উপকূলজুড়ে ভেসে উঠতে শুরু করেছে ঘূর্ণিঝড়ের রেখে যাওয়া ক্ষত। এভাবে উপকূলীয় ১৯ জেলার বেশির ভাগ জনপদই রেমালের তাণ্ডবে ক্ষতবিক্ষত। এসব অঞ্চলের অন্তত তিন কোটি মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার। উপকূলের জেলাগুলো ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ জেলার শতাধিক উপজেলা। কারো কারো টিনের চালা উড়ে গেছে, ঘর বিধস্ত হয়েছে। গাছপালা উপড়ে পড়েছে, ভেঙ্গে গেছে ডালপালা। উপড়ে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, ছিঁড়ে গেছে তার। দুই দিন ধরে বিদ্যুৎবিহীন উপকূলের অন্তত ৩ কোটি মানুষ। বিদ্যুৎ না থাকায় মোবাইল অপারেটর টাওয়ার অচল; টেলিযোগাযোগ প্রায় বন্ধ। ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে কয়েক লাখ গ্রাহক। রাস্তাঘাট ধসে গেছে। বিলীন হয়েছে বেড়িবাঁধ। ৫-৭ ফুট জলোচ্ছ্বাস ও ভারি বৃষ্টিতে প্লাবিত হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। জলজটে বন্দি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বেশির ভাগ মানুষ। ফসলের ক্ষেত তলিয়ে আছে পানির নিচে। ভেসে গেছে মাছের ঘের। গৃহস্তের পুকুরের মাছও ভেসে গেছে পানিতে। বাড়িঘর পানিতে ডুবে থাকায় অনেকে রান্না করতে পারছেন না। সুপেয় পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায়। স্বাস্থ্য সুরক্ষাও পড়েছে ঝুঁকির মুখে। দীর্ঘ সময়জুড়ে চলা রেমালের তাণ্ডবে রাস্তায় গাছ পড়ে থাকায় অনেক জায়গায় সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে পটুয়াখালী, বরগুনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, খুলনা, পিরোজপুর, ভোলা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ উপকূল পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। এ পর্যন্ত ২১ জনের মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রাণহানি ঘটেছে অনেক গবাদিসহ বন্য প্রাণীর। শুধু প্রাণিসম্পদ খাতে সাতশ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে সরকারি হিসাবে জানানো হয়েছে। দেড় লাখ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ ক্ষতির পরিমাণ তিন গুণেরও বেশি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যান্য খাতে আর্থিক ক্ষতির হিসাব নিরূপণের কাজ চলছে। ঝড়ের কারণে ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে সময় লাগবে আরো কয়েকদিন। ঘূর্ণিঝড় রেমালে প্রতিবেশী ভারতেও প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে। পূর্বমধ্য বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় রেমাল সাতক্ষীরা উপকূল থেকে কক্সবাজার উপকূলের দিকে রবিবার সন্ধ্যা ৮টা থেকে সোমবার সকাল ৯টা পর্যন্ত প্রায় ১৩ ঘন্টা ভয়াবহ তাণ্ডব চালায়। উপকূলে হানা দেয়ার সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১১১ কিলোমিটার। এরপর ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল বা স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে খুলনা-মানিকগঞ্জ-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ-সিলেট হয়ে ভারতের মেঘালয়ে প্রবেশ করে গতকাল মঙ্গলবার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সোমবার প্রাথমিক তথ্যে জানিয়েছে, খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, বরিশাল, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরগুনা, ভোলা, ফেনী, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর ও যশোর জেলায় ১০৭ উপজেলা এবং ৯১৪ ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৩৭ লাখ ৫৮ হাজার ৯৬ জন। সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে ৩৫ হাজার ৪৮৩টি ঘরবাড়ি। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত হয়েছে এক লাখ ১৪ হাজার ৯৯২টি ঘরবাড়ি। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে তিন দিনে রাজধানীসহ উপকূলের ১০ জেলায় অন্তত ২১ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ঢাকায় ৪, ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, পটুয়াখালীতে ৩, চট্টগ্রামে ২, খুলনা, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে। সোমবার ১০ জনের মৃত্যু খবর দিয়েছিল ত্রাণ মন্ত্রণালয়। মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, রেমালের প্রভাবে মৎস্য সম্পদ খাতে প্রায় ৭০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় ১৩টি জেলার প্রায় ৪১ হাজার মাছের ঘের, ২৬ হাজার ৩০০টি পুকুর এবং চার হাজার কাঁকড়ার ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানায়, রেমালের প্রভাবে প্রাণিসম্পদ খাতে প্রায় ১ কোটি ৪১ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপকূলীয় ৮টি জেলার প্রায় ৫০টি গবাদিপশু ও ৩০টি হাঁস-মুরগির খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মারা গেছে বেশকিছু ছাগল, ভেড়া ও হাঁস-মুরগিও। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) গঠিত মনিটরিং সেল গতকাল সকাল ১০টা পর্যন্ত তথ্যে জানিয়েছে, দীর্ঘসময় বিদ্যুৎ না থাকায় সারাদেশে মোবাইল অপারেটরদের টাওয়ারের ৫৮ হাজার ২৯৮টি সাইটের বিপরীতে ৩২ হাজার ৯০৬টি সাইট অচল রয়েছে। অচল সাইটের পরিসংখ্যান মোট সাইটের সংখ্যার ৫৬ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি অচল সাইটের সংখ্যায় এগিয়ে আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, গাজীপুর এবং ঢাকা এলাকা। এ কারণে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কাজী মোহাম্মদ নুরুল করিম জানিয়েছেন, রেমালের প্রভাবে সুন্দরবনে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গাছের ডাল ভেঙ্গে গেছে, অণুজীব মরে গেছে। বনের অভ্যন্তরে বন বিভাগের বিভিন্ন ক্যাম্প, সুপেয় পানির পুকুর, বন বিভাগের জলযান, স্টেশন ও ওয়্যারলেস সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ২৬টি হরিণসহ বেশ কিছু বন্যপ্রাণীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে রাজশাহী, দিনাজপুরসহ সারা দেশেই ব্যাপক হারে ঝরে পড়েছে আম। আম পাকতে শুরু করার সময় এ দুর্যোগে অপূরণীয় ক্ষতি হলো চাষিদের। ঝরে পড়া আমের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭-১০ টাকা। টানা ৩০ ঘণ্টার বেশি সময় বিদ্যুৎবিহীন থাকায় বরিশাল নগরীতে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে রান্নাবান্না। পানির অভাবে বন্ধ রয়েছে নগরীর বেশির ভাগ হোটেল-রেস্টুরেন্ট। এ জন্য কিনেও খাবার খেতে পারছেন না নগরবাসী। ঝড় চলে যাওয়ার পর বৃষ্টির তোড় কমে এলে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের কলবাড়ি গ্রামের চিংড়ি চাষি ও মুরগির খামারি মিঠু জানান, রবিবার রাতে তার খামারসহ দুটি ঘর ভেঙে গেছে। সেখানে থাকা দুই শতাধিক মুরগি মারা গেছে। ঝড়ে বিতরণ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে উপকূলীয় জেলাগুলোতে দুই কোটি ৭০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন; এর মধ্যে কেবল পল্লী বিদ্যুতের বিতরণ এলাকায় রয়েছেন ২ কোটি ৬৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৫০ জন। খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নাজমুল হুসেইন খান বলেন, ৫৫টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে এবং উপচে পড়া জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য গ্রাম। এ জেলার লাখো মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বিধ্বস্ত হয়েছে প্রায় ৭৭ হাজার ৯০৪টি বাড়িঘর। ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ লাখ ৫২ হাজার ২০০ মানুষ। এ ছাড়া ফসলের মাঠ, ঘের-পুকুর লোনা পানিতে ভেসে গেছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, দাকোপের খলিশা, পানখালী, বটবুনিয়া ও কামিনিবাসিয়া এবং কয়রার দশালিয়া বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। এই পাঁচটি জায়গা মিলে ১৫০ মিটারের মতো বাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, জেলায় এবার ১২ হাজার ৭৪৮ হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৭১৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষেতে ছিল; যা ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়েছে। বরগুনা জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে ২২ হাজার ৫০৪টি ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং ২ লাখ এক হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া জেলার ছয় উপজেলায় অন্তত আটটি পয়েন্টে বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।