নিজস্ব প্রতিবেদক:
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারনে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিয়ানমারে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক শোষণ ও তীব্র বৈষম্যের কারণে বেশ কয়েকবার রোহিঙ্গারা বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আর তাতে রোহিঙ্গাদের সামাল দিতে হিমসিম খেতে হচ্ছে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান নিয়ে জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। আর তাতে স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে। খুন, হত্যা, মাদক, চাঁদাবাজি- এরকম নানা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। আর তা সামাল দিতে বেগ পেতে হয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত বাহিনীর।
গত একমাস ধরে মিয়ানমার সীমান্তে ভয়াবহ সহিংসতা চলছে। এরই মধ্যে আরও রোহিঙ্গা যেনো অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছে বাংলাদেশ। গতবারের অনুপ্রবেশের ঢলের পরে তাদের দেশে ফেরাতে আন্তর্জাতিক দৃশ্যমান উদ্যোগ না থাকায় এবার বেশি সতর্ক থাকতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশ কয়েকবার বিশ্ব নেতৃবৃন্দদের জানিয়েছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এই অঞ্চলের মানবিক সংকট ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তিনি বলেন, দ্রুত মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান সম্ভব। আশা করি শিগগিরই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেবে।
সম্প্রতি মিয়ানমারের সংঘাতের পরে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য ওপারে সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে অনেক রোহিঙ্গা। গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় যুদ্ধ জোরালো করেছে আরাকান আর্মিসহ কয়েকটি গোষ্ঠী। তারা সম্মিলিতভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। এর মধ্যেই কোন কোন সীমান্ত শহর দখল করে নিয়েছে।
বান্দরবানের তমব্রু সীমান্তের বিজিবি ক্যাম্পে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ১৪ জন সদস্য পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। তারা নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের মধ্যে পালিয়ে এসেছেন। তাদের অস্ত্র ও গুলি বিজিবির কাছে জমা রাখা আছে। বান্দরবান সীমান্ত থেকে গোলাগুলির আওয়াজ এখনো আসছে।
সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের এই লড়াইয়ের ঘটনায় বাংলাদেশের একজন নাগরিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ভয় আর আতংকে সীমান্তঘেঁষা পাঁচটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করেছে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ ও মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগ। শনিবার থেকে রবিবার সকাল পর্যন্ত মিয়ানমারের ছোঁড়া দুটি মর্টার শেল ও একাধিক গুলি এসে পড়েছে তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ায়। এমন পরিস্থিতিতে আতঙ্কে গ্রাম ছেড়েছে অনেকে। যদিও সীমান্তের ওপারে চলমান সংঘর্ষ ও উত্তেজনায় বিজিবির পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানানো হয়।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের রেশ বাংলাদেশের সীমান্তে পড়ছে জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মিয়ানমারে আরাকান আর্মিদের সঙ্গে কনফ্লিক্টের (দ্বন্দ্ব) জন্য আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি বলেন, আমাদের সীমান্ত থেকে প্রায়শই গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়। একটা আতঙ্ক তো ছড়ায়। যুদ্ধটা আমাদের সঙ্গে না, এটা ওদের আভ্যন্তরীণ সংঘাত যার প্রভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশিদ বলেন, বিভিন্ন ফ্রন্টে বিরোধী সশস্ত্র গ্রুপের তুমুল প্রতিরোধের কারণে জান্তা সরকার কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা আমাদেরও কাঁধে। নতুনভাবে যাতে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে, এটা নিশ্চিত করতে সীমান্তে নজরদারি বাড়াতে হবে।
উল্লেখ্য, ১৯৪২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারটি বড় আকারের রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭৮ সালে প্রায় ২ লাখ, ১৯৯১-৯২ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার , ২০১৬ সালে প্রায় ৮৭ হাজার এবং ২০১৭ সালের আগষ্ট থেকে ২০১৮ সালের জানুয়ারির মধ্যে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ ৬১ হাজার ৭২৯ জন বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী কক্সবাজার জেলার টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলায় অবস্থান করছে। সাম্প্রতিক সময়ের সংঘাতে আরও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য অপেক্ষা করছে সীমান্তে।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কারনে কক্সবাজার-টেকনাফ এলাকা দিন দিন অপরাধপ্রবণ হয়ে উঠছে। রোহিঙ্গাদের কারনে মাদকের পাশপাশি অস্ত্রের চোরাচালান বেড়েছে এই সীমান্ত এলাকায়। সর্বশেষ গত আগস্টে অস্ত্রের কারখানা সন্ধানের পর র্যাব জানতে পারে- অস্ত্রের চালান যেত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে।