নিজস্ব প্রতিবেদক:
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনও এক বছরের বেশি সময় বাকি। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদারে দৌড়ঝাঁপ বাড়িয়ে দিয়েছে বিএনপি। এর মাধ্যমে সরকারকে চাপে রেখে জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা পেতে চায় দলটি। এ জন্য বিভিন্ন কর্মকৌশল গ্রহণ করেছে। দেশে দলের ক’জন সিনিয়র নেতা নিয়মিত কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন এবং বিদেশে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ কিছু নেতা তৎপর রয়েছেন। সূত্রমতে, স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতায় থাকাকালেই কিছু বিতর্কিত কর্মকা-ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সমর্থন হারাতে থাকে বিএনপি। আর ২০১৫ সালে লাগাতার আন্দোলনের নামে ব্যাপক সহিংসতার মাধ্যমে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে বহির্বিশ্বে আরও বন্ধুহীন হয়ে পড়ে দলটি। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াতের সম্মিলিত কিছু রাজনৈতিক কর্মকা-ের কারণে প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে চরম সম্পর্কের অবনতি হয়। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এদিকে দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারান্তরীণ ও বিভিন্ন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে গ্রেফতারের ভয়ে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সুদূর লন্ডন থেকে দেশে না ফেরায় বিএনপি এখন কার্যত অভিভাবকহীন। এ পরিস্থিতিতে কূটনীতিক তৎপরতা জোরদার করতে গিয়েও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না বিএনপি। এ ছাড়া দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বড় অংশ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রায় ১৬ বছর আগে ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে দিনদিনই বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হচ্ছে। না পারছে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে দলের শক্তি প্রদর্শন করতে, না পারছে সর্বস্তরে দল গুছিয়ে এগিয়ে যেতে।
এমন পরিস্থিতিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় থাকা বিএনপি নতুন উদ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার চেষ্টা করছে। এ জন্য ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি বিদেশে অবস্থান করা নেতারাও বিভিন্নভাবে লবিং জোরদার করছে। সূত্র জানায়, বিএনপি হাইকমান্ড চায় কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার দলের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে দলকে একটি ভাল অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। সে ক্ষেত্রে দল ক্ষমতায় যেতে না পারলেও যেন সম্মানজনক সংসদীয় আসনে বিজয়ী হয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে টিকে থাকা যায়। আর এ জন্যই সরাসরি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি পদ্ধতির মাধ্যমে যেন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে বিএনপি। এ জন্য একদিকে রাজপথে আন্দোলন ও অপরদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সহযোগিতা পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা গণতান্ত্রিক রাজনীতির অংশ। বিএনপি বেশ ক’বার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল। তাই বিএনপি কূটনীতিকদের সঙ্গে আগেও নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছে, এখনও রাখছে। এরই অংশ হিসেবে মাঝে মাঝে আমরা বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয় সে বিষয়ে আমরা তাদের সহযোগিতা চাই। আশা করছি এ ব্যাপারে তারা সহযোগিতার হাত বাড়াবে গণতন্ত্রের স্বার্থে। কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার অংশ হিসেবে ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিএনপি নেতারা। পরদিন ৮ সেপ্টেম্বর কানাডা হাই কমিশনের পলিটিক্যাল কাউন্সিলর ব্রাডলি কোটসের সঙ্গে বৈঠক করেছেন দলের নেতারা। বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলোচনায় প্রাধান্য পায় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। শীঘ্রই আরও ক’টি প্রভাবশালী দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠক করবেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির নেতারা। আগে থেকেই বৈদেশিক সহযোগিতা কমতে থাকলেও মূলত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর থেকেই বিএনপি বহির্বিশ্বের সহযোগিতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। ওই নির্বাচন বর্জনের পাশাপাশি পরবর্তীতে লাগাতার জ্বালাও পোড়াওসহ নাশকতামূলক রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করতে গিয়ে বিদেশে বন্ধুহীন হয়ে পড়ে দলটি। তাই মাত্র ক’টি দেশ ছাড়া অন্য দেশগুলো বিএনপিকে আগের মতো আর সহযোগিতা করছে না। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আবার নতুন করে বিএনপি কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। এ যাত্রায় চেষ্টা সফল না হলে দলটির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা নেমে আসবে। আর এ কারণেই বিএনপির সিনিয়র নেতারা কূটনৈতিক পাড়ায় দৌড়ঝাঁপ বৃদ্ধি করছে। লন্ডন থেকে তারেক রহমানও বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালীদের মাধ্যমে লবিং জোরদার করার চেষ্টা করছে। ২০০৬ সালে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়ার পর থেকেই বিএনপি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পর দলটি নতুন উদ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে। কিন্তু তাতে তেমন সফল হতে পারেনি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জনের পর বহির্বিশ্বের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের আরও অবনতি হয়। চরম অবনতি হয়। আর ২০১৫ সালে নেতিবাচক আন্দোলন করতে গিয়ে দেশ-বিদেশে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১০ মাস আগে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাজা হলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর আবারও জোরেশোরে কূটনীতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করে বিএনপি। তখন বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠকও করেন বিএনপি নেতারা। কিন্তু তাতে তেমন সাড়া না পেয়ে হতাশ হয়। এখন আবার নতুন উদ্যমে কূটনীতিক তৎপরতা জোরদারের চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, সরকার বিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে অতীতে রাজপথে নেতিবাচক কর্মসূচী পালন করে বিদেশী কূটনীতিকদের সমর্থন না পাওয়ায় খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পরও তাকে মুক্ত করতে রাজপথের কঠোর কর্মসূচীতে যায়নি বিএনপি। দফায় দফায় শান্তিপূর্ণ কর্মসূচী পালনের পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে মুক্ত করতে আইনী লড়াই চালিয়ে যায় দলটি। পাশাপাশি ঘরোয়া পরিবেশে সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করে খালেদা জিয়াকে মুক্তির দাবি জানাতে থাকে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। সেই সঙ্গে এ বিষয়ে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদেরও সহযোগিতা চায় তারা। তাতেও যখন সফলতার মুখ দেখেনি, তখন পরিবারের সদস্যরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করে খালেদা জিয়াকে সাময়িকভাবে মুক্ত করার চেষ্টা করে। এ কাজে বিদেশী কূটনীতিকদেরও সহযোগিতা নেয়। স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর ২০২০ সালের ২৫ মার্চ প্রথম দফায় শর্তসাপেক্ষে ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দুই শর্তের মধ্যে ছিল বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে এবং বিদেশে যাওয়া যাবে না। এর পর আরও ৪ দফায় ৬ মাস করে তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। আর সর্বশেষ ৫ম দফায় মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয় এ বছর ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তি ও বার বার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর জন্য তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে। প্রতিবারই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে মতামতের জন্য আবেদনটি আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে মতামত দেয়ার পর খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তি ও পরে আরও ৪ দফায় মুক্তির মেয়াদ ৬ মাস করে বাড়ানো হয়। তবে বিএনপি ও খালেদা জিয়ার স্বজনরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে চাইলেও আইনে সে সুযোগ না থাকায় সরকার তাকে বিদেশে যেতে দিতে পারেনি। এ বিষয়ে বিএনপি বিদেশী কূটনীতিকদের সহযোগিতা চাইলেও আইনী বিষয় হওয়ায় কূটনীতিকরা বিএনপিকে সহযোগিতা করেনি।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর এ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি অভিযোগ করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও বিভিন্ন তথ্য উপাত্তসহ চিঠি দিয়ে দাবির পক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পেতে জোরালো চেষ্টা চালায় বিএনপি।
কিন্তু বিএনপির অতীত কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলেও আশানুরূপ পরিবর্তন আসবে এমন ভরসা না পেয়ে বিএনপির তৎপরতায় সাড়া দেয়নি আন্তর্জাতিক অঙ্গন। জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বড় বড় দেশগুলো খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকা ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে নীরবতা পালন করে। তবে এবার বিএনপির পক্ষ হয়ে দেশের কিছু বিশিষ্ট নাগরিক নতুন করে লবিং করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। বিএনপি নেতাকর্মীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ঢাকায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পাশাপাশি দলের পক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লবিং করা হচ্ছে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তিতে থাকলেও রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় থাকায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান টুকু, সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেনসহ ক’জন সিনিয়র নেতা এবং ক’জন জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবী কূটনীতিক তৎপরতায় সক্রিয় রয়েছেন।
তারা ঢাকায় কর্মরত বিদেশী কূটনৈতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এছাড়া বিএনপি চেয়ারপার্সনের লন্ডন প্রবাসী ছেলে ও দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং বিভিন্ন দেশের কমিটিতে থাকা বিএনপি নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করতে সচেষ্ট রয়েছেন। ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে বিএনপিকে স্বাধীনতা বিরোধী দল হিসেবে চিহ্নিত জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে বলা হলেও এ বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ড এখন পর্যন্ত কার্যকরি কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। তবে জামায়াতের কারণে অতীতে কূটনৈতিক তৎপরতায় সফল হতে না পেরে বিএনপি এখন কৌশল গ্রহণ করেছে। আগে বিএনপির সকল কর্মসূচীতে জামায়াত সরাসরি উপস্থিত থাকলেও এখন কৌশলে তাদের দূরে রাখা হচ্ছে। অবশ্য জামায়াতের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রাখছে বিএনপির সিনিয়র নেতারা। তবে বিএনপি এখনও ২০ দলীয় জোট থেকে জামায়াতকে বাদ দেয়ার ঘোষণা না দেয়ায় বিদেশী কূটনীতিকরা বিষয়টিকে ভালভাবে দেখছেন না। তাই শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বিএনপির কূটনৈতিক তৎপরতা কতটা সফল হবে তা অনিশ্চিত। তবে বিএনপি নেতারা মনে করছেন, এ যাত্রায় তারা কূটনীতিকদের সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাস পাচ্ছেন।