নিজস্ব প্রতিবেদক:
সংরক্ষিত বনে জ্বলছে আগুন। নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়, এই আগুন মানবসৃষ্ট। স্থানভেদে প্রায় প্রতিদিনই জ্বলে। সঙ্গে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে চারপাশের পরিবেশ। ক্ষতিগ্রস্ত হয় গাছের চারাসহ ডালপালা ও বাকল। সেই সঙ্গে বসবাসের উপযোগিতা হারায় পাখিসহ উপকারী কীটপতঙ্গ। বাইরের দেশের কোনো দাবানলের কথা নয়, এই চিত্র খোদ দেশের জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের। অনেকের কাছেই ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন নামেও পরিচিত এই উদ্যান। আর এমন ধ্বংসাত্মক কাজের সঙ্গে জড়িত খোদ বনাঞ্চল রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তরাই। বর্জ্য পোড়ানোর এই কাজটি জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। এতে রীতিমতো অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান। বাংলাদেশে উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র এটি। ১৯৬১ সালে প্রায় ২০৮ একর (৮৪ হেক্টর) জায়গাজুড়ে উদ্যানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যেখানে প্রতিবছর প্রায় ১৫ লাখ দর্শনার্থী বেড়াতে আসেন। ঢাকার আরেকটি উদ্যান বলধা গার্ডেন প্রশাসনিক দিক দিয়ে এরই অংশ। যেখানে দর্শনার্থীদের প্রবেশ ঘিরে পলিথিন, প্লাস্টিকের প্যাকেটজাত খাবার নিয়ে হরহামেশাই প্রবেশ করেন। এর কারণ হিসেবে উদ্যানের দেখভালে ঘাটতিকেই দায়ী করছেন অনেকেই। সেই সঙ্গে উদ্যানের ভেতরে ক্যান্টিন-খাবার স্টল গড়ে ওঠাকেও দায়ী করেছেন কেউ কেউ।
এক অনুসন্ধানে দেখা যায়- সংরক্ষিত এই বনাঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন স্থানে দেওয়া হয়েছে সাইনবোর্ড। যেখানে লেখা রয়েছে বিভিন্ন সতর্কবার্তা। সঙ্গে রয়েছে আইন লঙ্ঘনে শাস্তির হুঁশিয়ারিও। যদিও এই নির্দেশনা মানতে মোটেই রাজি নয় উদ্যানের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। দেখা যায়- তারা উদ্যানের ভেতরের বিভিন্ন বর্জ্য এক জায়গায় জড়ো করছেন। অদূরে ছোট ছোট স্তূপ দিচ্ছেন। এরপর সেগুলো আগুনে পোড়াচ্ছেন। যদিও পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দাবি- কর্তৃপক্ষের নির্দেশনাতেই উদ্যানে ময়লা-আবর্জনা এভাবে আগুনে পোড়াচ্ছেন তারা।
বিষয়টিতে কথা বলেছে একাধিক পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সঙ্গে। তারা বলেছেন- নির্দেশনার আলোকে কাজ করছেন তারা। উদ্যানে তৈরি হওয়া বর্জ্য সরিয়ে নেওয়ার চেয়ে পুড়িয়ে ফেলাই সহজ ও নিরাপদ বলেও দাবি তাদের। কারণ, এখানকার অধিকাংশ বর্জ্য প্লাস্টিক। সরাতে গেলে ঝামেলা বাড়ে, সিটি করপোরেশনের গাড়িতে তুলে দিতে হয়। আর পোড়ানো হলে যেখানের ময়লা সেখানেই শেষ! । নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পরিচ্ছন্নতাকর্মী বলেন, ‘ময়লা পোড়ানো হয় মূলত ঝামেলা কমাতেই। ময়লা নিলে সিটি করপোরেশনকে টাকা দিতে হয়, তাও বাঁচে। যে পরিমাণ ময়লা বা প্লাস্টিক নিয়ে মানুষ উদ্যানে প্রবেশ করেন, তা অপসারণ করতে রীতিমত ট্রাক লাগবে। তাই শর্টকাট রাস্তা ময়লা পোড়ানো। কেউ কেউ আমাদের ওপর বিরক্ত হয়, আমাদেরই বা কি করার আছে? নির্দেশনার আলোকেই কাজ করছি। ময়লা পোড়ায় ফলে উদ্যানে সৃষ্ট ধোঁয়ায় বিরক্ত বেড়াতে আসা দর্শনার্থীরাও। কারণ, আগুনের স্তূপ থেকে ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। পরিবারের তিন সদস্যকে নিয়ে উদ্যানে বেড়াতে আসা ইউসুফ আলী বলেন, ‘ধোঁয়ায় বাচ্চারা বিরক্ত। কোথাও কোথাও তো নিশ্বাসও নেওয়া যায় না। আবার কোথাও খাবারে উচ্ছিষ্ট আর ময়লার দুর্গন্ধ। যেন দেখার কেউ নেই। এদিকে, উদ্যান ঘুরে দেখা গেছে- প্রতিটি প্রবেশমুখে দায়িত্বপ্রাপ্ত টিকেট চেকাররা বসিয়েছেন দোকান। সেখানে মিলছে চিপস, চকলেট, কোল্ড ড্রিংকস্ ছাড়াও পানির বোতল। এছাড়া অনেকেই বাইরে থেকেও খাবার সংগ্রহ করে ভেতরে প্রবেশ করছেন। যার প্রভাব পড়ছে উদ্যান ঘিরে। যত্রতত্র ছড়াচ্ছে প্লাস্টিকের বোতল, খাবারের উচ্ছিষ্ট, জন্মদিনের কেকসহ ফলমূলের খোসা। অন্যদিকে, উদ্যানে মাইক বা শব্দবর্ধক যন্ত্র ব্যবহার করা নিষিদ্ধ থাকলেও ক্যান্টিনে সারাক্ষণ উচ্চস্বরে গান বাজানো হচ্ছে। শব্দদূষণে প্রাণীরাও থাকে আতঙ্কিত। সেই সঙ্গে বর্জ্য অপসারণের নামে বনভূমিতে আগুন লাগার ঝুঁকি তো রয়েছেই। অনুমতি ছাড়া স্কুল-কলেজ ড্রেস পরিহিত অবস্থায় শিক্ষার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও অনেক শিক্ষার্থীদেরই উদ্যানে দেখা যায়। চোখে পড়ে হরহামেশা উদ্যানে ধূমপানের চিত্রও। সঙ্গে প্রধান প্রবেশ পথের পাশেই দেখা মেলে মাদকসেবীদের উপস্থিতি। আয়সা আক্তার নামে এক দর্শনার্থী বলেন, প্রকৃতির কাছাকাছি আসতেই বেড়াতে আসা। কিছু সময় হেঁটে ক্লান্তি আসাটাই স্বাভাবিক। এর জন্য নেই পর্যাপ্ত বসার স্থান। যেগুলো আছে তার অনেকগুলোই ব্যবহারের উপযোগী নয়। এছাড়া ময়লা ফেলার জন্য নেই পর্যাপ্ত ব্যবস্থা। সঙ্গে বর্জ্য পুড়িয়ে পুরো পরিবেশটাই নষ্ট করে দিচ্ছেন তারা। ফলে পরিবেশবাদীরা বলছেন, বায়ু দূষণের শীর্ষে থাকা ঢাকা শহরের বাসিন্দারা উদ্যানে বিশুদ্ধ বায়ু সেবন করতে আসেন। সবুজে ঘেরা নির্মল বায়ুর এই উদ্যানে এখন বর্জ্য পোড়ানো বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের দায়িত্ব থাকারা উদ্যানের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি ছাড়াও বায়ু দূষিত করছে। বর্জ্য পোড়ানোর ফেলে যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। এই আগুনে নিন্মস্তরের লতাপাতা ছাড়াও মাটি পুড়ে যায়। সঙ্গে কীটপতঙ্গও পুড়ে মারা যায়। তারা আরও বলছেন, বৃক্ষরাজি, প্রাণীকুল, প্রাকৃতিক সম্পদের উপযুক্ত ও নিরাপদ আবাসস্থল হলো বনভূমি বা বনাঞ্চল। আমাদের পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। পরিবেশ বিপর্যয়ের এই ক্রান্তিলগ্নে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশে বনের বৃক্ষ ও প্রাণিসম্পদ রক্ষার জন্য রয়েছে পৃথক পৃথক আইন বা বিধি। তবে বন আইন ও বন্যপ্রাণী আইন থাকা সত্ত্বেও বৃক্ষরাজি উজাড় এবং বন্যপ্রাণী নিধন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বন সংরক্ষণবিধি এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণবিধি আরও কঠোরতর করার প্রয়োজনীয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে পরিবেশবাদী সংগঠনের জোট ‘বাংলাদেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ জোটের’ (এনসিএ) আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে নিন্মস্তর বা খারাপ পদ্ধতি হলো পোড়ানো। অনেকেই অসচেতনতার কারণেই এটি করে থাকনে। যা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানেও করা হয়ে থাকে বলে জেনেছি। সম্প্রতি বর্জ্য পোড়ানোর প্রতিবাদ ও ভিডিও চিত্র ধারণ করায় এক পরিবেশকর্মীকে আটকে রাখাসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনাও উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, যে কোনো বনাঞ্চলে বর্জ্য পোড়ানো আইনগতভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ। এর ফলে পুরো বনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়াও এভাবে আগুন দিয়ে প্লাস্টিক বা পাতা পোড়ানোয় এক ধরনের বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। যাতে বায়ু দূষণ হয়। এই বায়ু দূষণ বনের গাছ-পালা, কীটপতঙ্গসহ মানুষরে স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বাড়ায়। এসব সার্বিক বিষয়ে কর্তৃপক্ষের খেয়াল রাখা জরুরি। বিষয়টিতে মিরপুর জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানের পরিচালক ড. মো জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, এখানে সিটি করপোরেশনের ভ্যান আছে, তারা ময়লা নিয়ে যায়। বর্জ্য পোড়ানোর বিষয়টি আমরা শনাক্ত করেছি। এখন আর পোড়ানো হয় না। সে অনুসারে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। উদ্যানে ক্যান্টিন বসানোসহ উচ্চস্বরে গান বাজানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন ঘটনা এখন আর ঘটছে না। আগে হয়ে থাকলেও এখন সম্পূর্ণভাবেই বন্ধ। এখানে দুইটি ক্যান্টিন চালু রয়েছে, সেগুলো বিধি মোতাবেক চলছে। উদ্যানে মাইক বাজানো নিয়ে জাহিদুর রহমান বলেন, মাইক বাজানো সম্পূর্ণ নিষেধ। বিষয়টি আমি নিজেও খেয়াল রাখছি। আমাদের পার্শ্ববর্তী যেসব জায়গা আছে, তাদের নাম বলব না, অনেকসময় সেখান থেকে সাউন্ড আসে। আমরা সবসময় চাই উদ্যান যেন নিরিবিলি শব্দদূষণ মুক্ত হয়। দর্শনার্থীরা যেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে পারেন। তবে বর্তামানে আগের চেয়ে উদ্যানের পরিবেশ দিন দিন ভালো হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি। উদ্যানে অপর্যাপ্ত ময়লা ফেলার স্থানের বিষয়ে তিনি বলেন, ডাস্টবিন আমাদের অপর্যাপ্ত রয়েছে। তবে বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। সঙ্গে বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা আমরা ভিজিটর সেন্টারে করেছি। যদিও আর্থিক সংকট রয়েছে, তারপরও দর্শনার্থীদের উপযুক্ত পরিবেশ দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বনভূমির বৃক্ষরাজিকে রক্ষার জন্য ১৯২৭ সালে বন সংরক্ষণ আইন করা হয় যা ১৯৯০ সালে সংশোধন করে অধিকতর সময়োপযোগী করা হয়। ১৯৯৬ সালেও এ আইনের কিছু সংশোধন করা হয়। এতে বনসম্পদ সংরক্ষণের নিমিত্তে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। যেখানে বলা হয়- বিনা অনুমতিতে সরকারি বনাঞ্চলে গাছকাটা, অপসারণ, পরিবহন, ঘরবাড়ি তৈরি, চাষাবাদ করা, গবাদিপশু চরানো, আগুন জ্বালানো এবং বনের কোনো রকম ক্ষতিসাধন করা যাবে না। বন আইন লঙ্ঘনের জন্য নূন্যতম ছয়মাসের জেলসহ পাঁচ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেলসহ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। এছাড়াও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে একটি আইন প্রণয়ন করে যা বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ), আদেশ, ১৯৭৩ নামে পরিচিত। এ আইনে বলা হয়েছে- বিনা অনুমতিতে যে কোনো উপায়ে বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণী শিকার বা হত্যা করা, বন্যপ্রাণী প্রজননে বিঘ্ন সৃষ্টি, জাতীয় উদ্যানের সীমানার এক মাইলের মধ্যে কোনো প্রাণী শিকার, বিদেশি প্রাণী আমদানি বা বিদেশে রফতানি করা প্রভৃতির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এ আইন লঙ্ঘন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং আইন ভঙ্গকারীকে আর্থিক জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়ার বিধানও রয়েছে। তবে মানুষের জীবন বাঁচাতে, ফসলের ক্ষতি রোধ ইত্যাদি ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী শিকার বা হত্যা করা অপরাধের শামিল হবে না বলেও এই আইনে বলা আছে।