নিজস্ব প্রতিবেদক:
বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার, যে আইনের মূল লক্ষ্যই হবে দেশের আমদানি ও রপ্তানি খাতকে আরও বেশি নিয়ন্ত্রণ করা। প্রস্তাবিত আইনের অধীনে একটি অধিদফতর থাকবে, যাকে আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে বিপুল ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। খসড়া আইনের অন্তত দুটি ধারা ও দুটি অনুচ্ছেদে এ নিয়ন্ত্রণ আরোপের বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে। ওই ধারা ও অনুচ্ছেদগুলো নিয়ে আপত্তি তুলে সেগুলো বাতিলের বিষয়ে মতামত দিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ আইনটির খসড়া তৈরি করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বাণিজ্য সংগঠনগুলোর মতামত চেয়েছে। গত ২৮ আগস্ট খসড়া আইনটির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মতামত পাঠায় এফবিসিসিআই। ‘বাণিজ্য (আমদানি ও রপ্তানি) ব্যবস্থাপনা আইন-২০২২’ শীর্ষক এ আইনের খসড়ার শিরোনামে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য সম্প্রসারণ, উন্নয়ন ও ক্ষেত্র বিশেষে কোনো কোনো পণ্য ও সেবা আমদানি বা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ করার লক্ষ্যে আইনটি প্রণীত হচ্ছে। আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান অন্য আইনের ওপর প্রস্তাবিত আইনটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। খসড়ায় উল্লেখ আছে, আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাক না কেন, এ আইনের বিধানবলি প্রাধান্য পাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (অভ্যন্তরীণ আমদানি) এ কে এম আলী আহাদ খান বলেন, ১৯৫০ সালে করা ‘দ্য ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট (কন্ট্রোল) অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন ছিল, ওই আইনের মাধ্যমেই দেশের আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এখন বৈদেশিক বাণিজ্যে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করার লক্ষ্যে বাংলায় এই আইনটি পরিবর্তন করা হচ্ছে। প্রস্তাবিত আইনে নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা সম্পর্কে তিনি বলেন, জনগণের স্বার্থে ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকারের কিছু নিয়ন্ত্রণ থাকবেই। তারপরও ব্যবসায়ীদের কোনো আপত্তি থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হবে। প্রস্তাবিত আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে আইনে একটি অধিদফতর গঠনের কথা বলা হয়েছে, যে অধিদফতরের কাছ থেকে আমদানি ও রপ্তানির এলসি করার জন্য যাবতীয় অনুমতি নিতে হবে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের। এ অধিদফতর সময় সময় নির্দেশনা বা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে যে কোনো ধরনের পণ্যের আমদানি বা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধও করতে পারবে। গঠিত অধিদফতর বর্তমান আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের স্থলাভিষিক্ত হবে এবং ওই প্রতিষ্ঠানটির দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করবে। ফলে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দফতর নামে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম বিলুপ্ত হবে। শুধু তাই নয়, আমদানি ও রপ্তানি সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক, ব্যাংক, বীমা, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অথবা সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা আমদানি পণ্যের ব্যবহার ও বিক্রি সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য এ অধিদফতরকে দিতে বাধ্য থাকবে। অধিদফতরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমদানিকারক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক অথবা অন্য কোনো সরকারি-বেসরকারি কর্তৃপক্ষের দফতরে সংরক্ষিত রেকর্ড বা নথি অথবা আমদানিকৃত পণ্যের মজুদ সরেজমিন পরীক্ষা করতে পারবেন। উপরন্তু কাস্টমস কর্তৃপক্ষ থেকে পণ্য ছাড় করার জন্য আমদানি অনুমতিপত্র বা এলসি পারমিট, পণ্য ছাড়করণ অনুমতিপত্র বা ক্লিয়ারেন্স পারমিট, ফেরতের ভিত্তিতে আমদানির অনুমতিপত্র এবং ফেরতের ভিত্তিতে রপ্তানির অনুমতিপত্রসহ এ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুমোদন নিতে হবে প্রস্তাবিত অধিদফতরের মহাপরিচালক বা তৎকর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে। মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত নিবন্ধন, সনদ বা অনুমতিপত্রের শর্ত পালন না করে কোনো পণ্য আমদানি ও রপ্তানি করা যাবে না। নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা ও অনুচ্ছেদ : খসড়া আইনের ১০ নম্বর ধারায় আমদানিকারক, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীকে ‘শিল্প ভোক্তা’ অভিহিত করে বলা হয়েছে, এ ‘শিল্প ভোক্তা’ অধিদফতরের মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অনুমতি ব্যতীত শিল্প-কারখানায় ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অথবা অবাধে আমদানিকৃত কোনো পণ্যই বিক্রয়, হস্তান্তর আমদানির সুনির্দ্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না। আমদানি ও আমদানি সংক্রান্ত পণ্যের তথ্য প্রদানের বাধ্যবাধকতা বিষয়ক ১১ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, আমদানি অথবা রপ্তানি সংক্রান্ত আমদানিকারক, ব্যাংক, বীমা, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা- আমদানিকৃত যে কোনো পণ্যের ব্যবহার ও বিক্রয় সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য (অধিদফতরের) মহাপরিচালক বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে কোনো কর্মকর্তার চাহিদা অনুযায়ী দিতে বাধ্য থাকবে। নিয়ন্ত্রণমূলক এ দুটি ধারা বাতিলের বিষয়ে মতামত দিয়েছে এফবিসিসিআই। এ ছাড়া খসড়া আইনে আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা শিরোনামে ৮ নম্বর ধারায় (ঙ) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, কাস্টমস অ্যাক্ট-১৯৬৯-এর সেকশন ১৫ ও ১৬-এর অধীন আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রিত বা নিষিদ্ধ পণ্য এ আইনের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে এবং উভয় আইনের সব বিধানাবলি তদানুসারে প্রযোজ্য হবে। এবং (চ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনে যা কিছুই থাক না কেন, সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের উদ্দেশ্যে গুদামজাতকরণের জন্য অথবা বিদেশে প্রেরণের জন্য আমদানিকৃত যে কোনো পণ্য বা সেবা খাতে নিয়ন্ত্রণ বা নিষিদ্ধ বা শর্তারোপ করতে পারবে। আলোচিত অনুচ্ছেদ দুটিও বাতিলের বিষয়ে মতামত দিয়েছে এফবিসিসিআই। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ এ বাণিজ্য সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, সরকার এমনিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, স্পেশ্যাল পাওয়ার অ্যাক্ট ব্যবহার করে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে; এর ওপর প্রস্তাবিত আইনে এমন কিছু নিয়ন্ত্রণমূলক ধারা সংযোজন করা হয়েছে, যেগুলো অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে বলে আমরা সেগুলো বাতিলের বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মতামত পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে যে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক আইন ব্যবসা-বাণিজ্যকে সংকুচিত করে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে আমদানি-রপ্তানির ওপর নতুন করে আইনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ আরোপ হলে তা দেশের ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আমরা মনে করছি।