আন্তার্জাতিক ডেস্ক:
পার্টির চাঁদা দেওয়া প্রায় দেড় লাখ সদস্যের ভোটে নির্বাচিত লিজ ট্রাসই হচ্ছেন ব্রিটেনের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে তুলনা করা হচ্ছে আয়রন লেডিখ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাককে পেছনে ফেলে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। ঋষি সুনাক ও লিজ ট্রাসের মধ্যে ভোটের ব্যবধান প্রায় ২১ হাজার। লিজ ট্রাস ৮১ হাজার ৩২৬ ও রিশি সুনাক পেয়েছেন ৬০ হাজার ৩৩৯ ভোট। ৪৬ বছর বয়সী লিজ ট্রাস উত্তর ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। পুরো নাম ম্যারি এলিজাবেথ ট্রাস। বিয়ে করেছেন ২০০০ সালে। দুই সন্তানের জননী। তার জন্মস্থান উত্তর ইংল্যান্ডে। যেখানে লেবার পার্টি শক্তিশালী। ট্রাস নিজেকে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট বলে দাবি করেন। যা তাঁর কেন্দ্রীয় নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইকোনমিস্ট ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে বলেছিল, ট্রাস থ্যাচারের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করছেন। সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের প্রশংসা করতে কখনই ক্লান্ত হতে দেখা যায়নি ট্রাসকে। এলিজাবেথ ট্রাস অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়েছেন। সেখানই তিনি অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রক্ষণশীল পার্টির আদর্শের প্রতি ঝুঁকতে শুরু করেন। এ ছাড়া তিনি বেসরকারি ক্ষেত্রে কমার্শিয়াল ম্যানেজমেন্টের কর্মী হিসেবে ১০ বছর জ্বালানি ও টেলিযোগাযোগ শিল্পে কাজ করেছেন। ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ে তিনি একাধিক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিটিতেই পরাজিত হয়েছেন। এরপর ২০১০ সালে হাউস অব কমন্সে একটি আসন জিতে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হন। ২০১২ সালে, ট্রাস এডুকেশন ও চাইল্ড কেয়ার বিভাগের উপসচিব পদে নিযুক্ত হন। পরে পরিবেশ, খাদ্য সম্পর্কিত বিভাগেরও দায়িত্ব পান। প্রচারে এই বিষয়গুলোরও উল্লেখ করছেন বরিস জনসন মন্ত্রিসভার এই পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব তিনিই সামলাচ্ছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ট্রাস ব্রিটেনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। প্রায় তাঁকে দেখা গেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানাতে ও প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কঠোর নিন্দা করতে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর আগে তিনি ব্রেক্সিট নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনার দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়া নিয়ে গণভোটের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন তিনি। পরে, অবশ্য ট্রাস ভুল স্বীকার করেন। গণভোটের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার পরও তাঁকে ব্রেক্সিট নিয়ে গুরুদায়িত্ব দেওয়ায় প্রশংসা করেন। ট্রাস শুরু থেকেই রক্ষণশীল ছিলেন না। বামপন্থি মা-বাবার কাছে তার বেড়ে ওঠা। ছিলেন মধ্যপন্থি লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কিশোরী সদস্য। মাত্র ১৯ বছর বয়সে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তির আহ্বান জানিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রিটিশ রাজনীতির প্রভাষক ডেভিড জেফরি বলেন, ‘বর্তমানে ট্রাস যে পার্টি করছেন মানে কনজারভেটিভ তা সহজাত স্বাধীন মুক্তবাণিজ্যকে সমর্থন করে না। এটা আসলে অসমতা কমানোর লক্ষ্যে জনসন প্রচারিত একটি নীতিকে নির্দেশ করে।’ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ নিয়ে ২০১৬ সালের জুনে হওয়া গণভোটে বরিস জনসনের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন ট্রাস। তিনি চেয়েছিলেন ব্লকে থেকে যেতে। লিজ ট্রাসকে আয়রন লেডি খ্যাত সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের সঙ্গে নানা কারণে তুলনা করা হচ্ছে । কয়েক মাস ধরে ট্রাস ব্রিটিশদের পেশাদারভাবে স্টাইল করা ফটো দিয়ে বিনোদন দিচ্ছেন। যা প্রায় থ্যাচারের মুহূর্তগুলোর কার্বন কপি। যেমন যখন তিনি মস্কো গিয়েছিলেন, তখন একটি লম্বা কোট এবং পশমের টুপি পরেছিলেন। ঠিক ৩৫ বছর আগে থ্যাচার যেমনটা করেছিলেন। ট্রাস ৩০ বিলিয়ন পাউন্ড (৩৭ বিলিয়ন ডলার) ট্যাক্স কমানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন অনেকটা থ্যাচারের মতো। থ্যাচার আশির দশকে ব্যক্তিগত আয়কর কমিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবিলায় অবিলম্বে পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ট্রাসের মতে, এই পদক্ষেপ মুদ্রাস্ফীতিকে লাগাম টেনে ধরতে পারবে। ‘ট্রুসোনোমিকস’ হলো ট্রাসের প্রস্তাবের জন্য ব্যবহৃত শব্দ। সরবরাহ-সদৃশ অর্থনীতি তাঁর নিজস্ব সংস্করণ। এটা থ্যাচারের অর্থনৈতিক নীতির একটি মূল বৈশিষ্ট্য। ট্রাসের পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে করপোরেট আয়করের পরিকল্পিত বৃদ্ধি প্রত্যাহার এবং সামাজিক নিরাপত্তা হারের সাম্প্রতিক বৃদ্ধিকে ফিরিয়ে আনা। সাংস্কৃতিক ফ্রন্টে ‘পরিচয়ের রাজনীতির’ বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ট্রাস। জেফরি বলেন, ‘কোনো প্রশ্নই নেই যে ট্রাস মাঝেমধ্যে নিজেকে থ্যাচার মনে করেন। থ্যাচারের একটি পরিষ্কার ধারণা ছিল যে তিনি দেশটিকে কেমন দেখতে চান। তবে এটি স্পষ্ট নয় যে ট্রাসের দৃষ্টিভঙ্গি একই।’ থ্যাচার ছাড়াও বরিস জনসন-পরবর্তী ধারাবাহিকতাও মেনে চলতে চান ট্রাস। বিশেষ করে ব্রেক্সিট-সংক্রান্ত ইস্যুগুলো। সেই সঙ্গে দেশে বর্তমানে প্রধান সমস্যা জ্বালানি বিল, সেটার জন্য ক্ষমতা নেওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন সহায়তা ঘোষণা নিয়ে আসবেন বলে জানা গেছে। তবে এসব কিছুর বাইরে খুব দ্রুত সাধারণ নির্বাচন দিয়ে জনগণের রায়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চাইবেন লিজ ট্রাস। তখন বোঝা যাবে জনগণের আস্থা কতটুকু নিতে পারছেন তিনি।