নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের স্বাস্থ্য খাতে অন্যতম প্রধান ঝুঁকি এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর সংক্রমণ। প্রায় প্রতি বছরই নির্দিষ্ট সময়ে সংক্রামক ব্যাধিটির প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মহমারি করোনার পাশাপাশি আতঙ্ক তৈরি করেছে ডেঙ্গু। কেড়ে নিয়েছে ৫০০- এর অধিক প্রাণ। তবে এ বছরের শুরু থেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় ছিল মশাবাহিত রোগটি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে পরিস্থিতি ছিল অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।
তবে বছরের মাঝামাঝি এসে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে রোগটি। বছরের প্রথম পাঁচ মাস সংক্রমণের হার অত্যন্ত কম থাকলেও গত তিন মাসে তা আকাশ ছুঁয়েছে। একইসঙ্গে বেড়েছে প্রাণহানির ঘটনাও। বিশেষত রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণের হার সর্বাধিক। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বেশি রাজধানীর বাইরে। বছরের পাঁচ মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ ছিল মে মাসে। এ সময় ১৬৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সেখানে সেপ্টেম্বরের একদিনেই ১৭৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর একদিনে সর্বোচ্চ ২৫১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে গত ৩১ আগস্ট।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সী অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্যমতে, এখন পর্যন্ত মশাবাহিত রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ছয় হাজার ৩৫৭ জন রোগী। এর মধ্যে সর্বোচ্চ তিন হাজার ৫২১ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে আগস্ট মাসে। এছাড়া জানুয়ারি মাসে ১২৬, ফেব্রুয়ারিতে ২০, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩, জুনে ৭৩৭ এবং জুলাই মাসে এক হাজার ৫৭১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। আর এখন পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এর মধ্যে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত জুন মাসে। জুনে মোট একজন মৃত্যুবরণ করেছিল। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে মৃত্যু দেখেছে দেশ। জুনের একজনের পর জুলাইয়ে নয়জন, আগস্টে সর্বোচ্চ ১১ জন এবং সেপ্টেম্বরের একদিনে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তবে আশার দিক হলো হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে মোট পাঁচ হাজার ৫৫৪ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন।
এদিকে অধিদফতরের তথ্য মতে, হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকার ৪৭টি ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন পাঁচ হাজার ২৩৪ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১০ জন। অপরদিকে রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এক হাজার ১২৩ জন। আর মারা গেছেন ১২ জন। অর্থাৎ রোগীর সংখ্যা ঢাকার বাইরে কম হলেও মৃত্যুর সংখ্যা বেশি।
শুরুতে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বছরের মাঝে এসে বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। এর কারণ জানতে চাইলে প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে কারণ এখন সময়টাই ডেঙ্গুর। মে-জুন থেকে শুরু করে শীতের আগ পর্যন্ত দেশে এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এবার বাড়ার কারণ বৃষ্টিটা ঠিক মতো হচ্ছে না। মাঝে মাঝে হচ্ছে, যা মশার প্রজননে সহায়তা করছে। মশা সৃষ্টির শুরু থেকেই ছিল এবং থাকবে। এটিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা সম্ভব না। আর মশা থাকলে ডেঙ্গুও থাকবে। তবে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্যোগ নিয়েছে। তবে আরও উদ্যোগ নেওয়া দরকার। সতর্ক হলে রোগীর সংখ্যা কমানো সম্ভব। ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েছে কারণ এখন সময়টাই ডেঙ্গুর। মে-জুন থেকে শুরু করে শীতের আগ পর্যন্ত দেশে এর প্রাদুর্ভাব বাড়ে। এবার বাড়ার কারণ বৃষ্টিটা ঠিক মতো হচ্ছে না। মাঝে মাঝে হচ্ছে, যা মশার প্রজননে সহায়তা করছে।
একই প্রশ্নের জবাবে প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। এটি বাড়ার কারণ মশা বেড়ে গেছে। অর্থাৎ মশা বাড়ার কারণগুলোই ডেঙ্গু সংক্রমণ বাড়ার কারণ। এক্ষেত্রে আমরা যতই উদ্যোগ নেই, তা কার্যকর হচ্ছে না বলা যায়। আমাদের উত্তর সিটি করপোরেশনের আতিক সাহেব ডেঙ্গু মশা নিধনে খুবই দৌড়াদৌড়ি করছেন। কিন্তু টায়ার, ডাবের খোসা এসব কিছু রয়ে যাচ্ছে বলে আমার মনে হয়। ফলে মশা বৃদ্ধির হারটা বেড়ে গেছে।তিনি আরও বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। এটি যদি থেকে যায়, তাহলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়ার সম্ভাবনা আছে। একটানা যদি অনেক বৃষ্টি হয়, তাহলে বাড়বে না। কিন্তু থেমে থেমে বৃষ্টি হলে তা বাড়বে। কারণ এতে অল্প পানি জমে। আর এতে মশার প্রজনন বৃদ্ধি পায়। জানতে চাইলে অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ বলেন, ‘হাসপাতালে প্রস্তুতি যতটা থাকা দরকার তা নেওয়া হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা দক্ষ, তাদের অতীতে এর থেকেও খারাপ পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। আমরা দেখছি তারা ভালোই কাজ করছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের সেবা দিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আশাকরি কোনো সমস্যা হবে । হাসপাতালে আশা রোগীদের যেন দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া যায়, কোনো ধরনের অবহেলা না থাকে সে দিকে নজর দিতে হবে। এটি একটি জরুরি পরিস্থিতি। এটি মূলত শহর কেন্দ্রিক। তাই সেসব এলাকায় প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব এলাকার চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সহানুভুতিশীল হতে হবে।
—অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম, উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ও প্রখ্যাত ভাইরোলজিস্ট
অধ্যাপক নজরুল বলেন, ‘যেহেতু চেষ্টার পরেও ডেঙ্গু রোগী সংখ্যা বাড়ছে তাই হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা উচিৎ। আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়াদের মধ্যে একটা বড় অংশ শিশু। ভর্তির সাথে সাথে তাদের চিকিৎসা শুরু করতে হবে। হাসপাতালে আশা রোগীদের যেন দ্রুত চিকিৎসা দেওয়া যায়, কোনো ধরনের অবহেলা না থাকে সে দিকে নজর দিতে হবে। এটি একটি জরুরি পরিস্থিতি। এটি মূলত শহর কেন্দ্রিক। তাই সেসব এলাকায় প্রাদুর্ভাব বেশি, সেসব এলাকার চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সহানুভুতিশীল হতে হবে।