নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিশ্বের সবচেয়ে শব্দ দূষণপ্রবণ সিটি ঢাকা। এই নগরীর বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ শব্দ দূষণের কারণে কানে কম শুনছেন। ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট আইন আছে, তবে এর কোনো প্রয়োগ নেই। অনেকে আইন জানেন না, কেউ কেউ জেনেও তা লঙ্ঘন করেন। এজন্য আইনের প্রয়োগের পাশাপাশি এক্ষেত্রে নাগরিকদের সচেতন হওয়ার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ বলা আছে, ভূমির ব্যবহার অনুযায়ী নির্দিষ্ট এলাকায় দিনে ও রাতে শব্দের মাত্রা (ডেসিবল) কেমন হবে, কী ধরনের কাজ দিনে-রাতে কোন সময় পর্যন্ত করা যাবে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সব স্থানেই শব্দের তীব্রতা প্রায় একই রকম। আইনের মান্যতায় সাজার বিধান থাকলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (১৯৯৯ সালের গাইডলাইন) মানদণ্ড অনুসারে, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। সে হিসেবেও রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের প্রতিনিয়ত জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচারে পিষ্ট হতে হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত এক বছর ঢাকা শহরের ১০টি স্থানের শব্দের তথ্য উপাত্ত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সংগ্রহ করে। সংস্থাটির জরিপ বলছে, ১০টি স্থানের নীরব এলাকায় ৯৬.৭% সময় আদর্শ মান (৫০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১.২% সময় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, মিশ্র এলাকায় ৮৩.২% সময় আদর্শ মান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১% সময় আদর্শ মান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮.২% সময় আদর্শ মান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে। সমগ্র ঢাকা শহরের ১০টি স্থানেই ৮২% সময় ৬০ ডেসিবলের উপরে শব্দ পাওয়া গিয়েছে।
চলতি বছরে বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের দেওয়া তথ্য বলছে, শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে মারা গেছে দুই লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। যেখানে পরিবেশদূষণকে বিশ্বে রোগ বিস্তারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও বিপর্যয় রোধে আইনের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে কথা হয় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মারুফা গুলশান আরার সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিবেশ নিয়ে বাংলাদেশে মোটামুটি ১৮০ থেকে ১৮৫টি আইন আছে। বাস্তবে প্রয়োগ নেই। সরকারের একার পক্ষে দূষণ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নাগরিক সচেতনতার মাধ্যমেই দূষণ কমানো সম্ভব।
এই আইনজীবী বলেন, বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দ দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা রয়েছে। তাতে উল্লেখ আছে, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না।
মারুফা বলেন, আইনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে পরিবেশ সংরক্ষণ, উন্নয়ন সাধন, দূষণ কমাবো। কিন্তু বিভিন্ন উৎস থেকে যে পরিমাণ কার্বন বা দূষণ হচ্ছে তা কী করে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে এবং মানুষের শরীরের যে ক্ষতিগুলো হয় সেগুলো দেওয়া (লেখা) আছে আইনে। এই আইনে ক্লিয়ারেন্স সনদের কথা বলা হয়েছে। কোনো প্রজেন্ট বা ইন্ড্রাস্ট্রি করতে চাইলে ক্লিয়ারেন্স সনদ কী করে নিতে হবে তাও বলা আছে। আইনটির মূল লক্ষ দূষণ কমানো।
মারুফা গুলশান আরা আরও বলেন, দ্য ইমারেটর কনজারভেশন ১৯৯৭ এখানেও বিভিন্ন স্টান্ডার্ডের কথা বলা হয়েছে। ব্রিক মেনোপেকসারিং অ্যান্ড ব্র্রিক প্রিন্স ইস্টাবলিসমেন্ট কন্টোল অ্যাক্ট ২০১৩ (ইট-ভাটা-প্রতিষ্ঠা-(নিয়ন্ত্রণ)-এর প্রস্তুতি-অ্যাক্ট-২০১৩) ইটের ভাটার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে। কী কী ব্যবহার করলে দূষণ কমবে সেটাও বলা হয়েছে। জ্বালানি কাঠের মাধ্যমে অনেকাংশেই পরিবেশ দূষণ হয়। সে ক্ষেত্রেও বিধান আছে।এই আইনজীবী বলেন, সড়ক পরিবহন আইন নামে যেটি পরিচিত যেটা ২০১৮ সালের আইন। এই আইনে শুধু বায়ু দূষণের কথাই নয়, গাড়ির লাইসেন্স থেকে শুরু করে রেজিস্ট্রেশন কী করে হবে প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদা করে বলা আছে। চালক কখন হর্ন বাজাবেন, কী করবেন না করবেন, তাও উল্লেখ করা আছে। যা অনেক জরুরি আইন। কিন্তু এই আইনের বাস্তবায়ন নেই বললেই চলে। এই আইনের অষ্টম অধ্যায়ে পরিবেশ দূষণকারী ঝুঁকিপূর্ণ মোটরযান বিধিনিষেধ উল্লেখ আছে। ধারা ৪৬ এ বলা হয়েছে- এই আইনটি পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ সালের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, সরকার নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি ধোঁয়া নির্গমণ বা অন্য কোনো প্রকার নিঃসরণ বা নির্গমণ করলে ওই মোটরযান চালক বা মালিক বা পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান চালনা করতে পারবে না।
ধারা-৪৬ এর ৩ এ বলা হয়েছে, পরিবেশ দূষণকারী এমন কোনো যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মোটরযানে ব্যবহার করা যাবে না। বাংলাদেশে বেশিরভাগ গাড়িই এই আইনের আওতায় চলতে পারে না। ধারা ৪৬ এর ৪ এ বলা হয়েছে, কোনো ত্রুটিপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষিত বা বিধিনিষেধ আরোপকৃত বা সড়ক বা মহাসড়কে চলাচলের উপযোগী নয় এমন মোটরযান চালনার অনুমতি দেওয়া যাবে না। যেখানে সরকার যন্ত্রগুলো ব্যবহারের পদ্ধতি বলে দিয়েছে। সেই সাথে ইন্ড্রাস্টিগুলোকে আইন অনুসারে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত কার্বন দূষণ করলে ট্যাক্স ধরে দেবে। বাস্তবে তারা করেই যাচ্ছে কিন্তু ট্যাক্স আরোপ করা হচ্ছে না।
পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিধিমালার শতভাগ বাস্তবায়নের পাশাপাশি (বিধিমালার) সংজ্ঞা অনুযায়ী চিহ্নিত জোনসমূহে (নীরব, আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও মিশ্র) সাইনপোস্ট উপস্থাপন করে জনসাধারণকে সচেতনসহ অমান্যতার ব্যাপারে নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। অযাচিত হর্ন বন্ধসহ সন্ধ্যার পর ছাদ ও কমিউনিটি হলে গান-বাজনা বাজাবেন না এবং পটকাবাজি বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে রাতের বেলায় ব্লেন্ডার, প্রেশার কুকার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ড্রিল ও গ্রাইন্ডিং মেশিনের ব্যবহার সীমিত করতে হবে।
পরিবেশবাদীরা মনে করেন, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশন (ক্যামস) এর ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে। সেই সাথে জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, আইন প্রণেতা, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সংবাদকর্মী ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে সমন্বিত, অংশীদারিত্বমূলক, বিজ্ঞানভিত্তিক, টেকসই ও কার্যকরী পদক্ষেপ/সমাধান গ্রহণ করতে হবে।
এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক মো. জিয়াউল হক বলেন, ‘শব্দ দূষণে আমরা আন্তরিক কাজ করে যাচ্ছি। মূলত আমাদের নাগরিকরাই দূষণের সঙ্গে জড়িত। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন সচেতনতা। অধিদফতরের একটা শাখা শব্দ দূষণ রোধে কাজ করে যাচ্ছে অনবরত। তবে সবাই সচেতন না হলে শুধু পরিবেশ অধিদফতর কিছু করতে পারবে না।’
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘দেশে পরিবেশ রক্ষায় যত ভালো ভালো আইন আছে, বিশ্বের বহু দেশেই এত ভালো আইন নেই। এখানে আইন বাস্তবায়নে সমস্যা রয়েছে। আমরা অনেক কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারি না।’
তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘যেখানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ক্ষমতা থাকার কথা, তা নেই। এমন অনেকগুলো বিষয় আছে, যেগুলো আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। এর জন্য দেশের বৃহৎ একটা অংশের আওয়াজ তুলতে হবে। আজকে পরিবেশ নিয়ে মানুষ যা ভাবছেন, তারও ভাবতে হবে। এই যে বিধিমালা হয়েছে, এর আগে আইন হওয়া জরুরি ছিল। আমরা শত চেষ্টা করার পরেও পারিনি। তাও বলবো, উন্নতি হয়েছে, আগে তাও ছিল না। প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও অগ্রসর হচ্ছি।’