নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত বড় দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে একে অপরের উদ্দেশ্যে আক্রমণাত্মক বাক্যবাণ, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, এমনকি সংঘাত-সহিংসতা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সম্প্রতি রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশে জেলা পর্যায়ের এক নেতা তার বক্তব্যে ‘শেখ হাসিনাকে কবরস্থানে পাঠাতে হবে’ বলার পর আওয়ামী লীগে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, চলে দেশব্যাপী বিক্ষোভ। এদিকে জাতীয় নির্বাচনের আরও সাত-আট মাস বাকি। এ নির্বাচন সামনে রেখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে একের পর এক কর্মসূচি দিচ্ছে বিএনপি। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে দলটির কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে, আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে বাসে। এর আগে, খুলনা, পটুয়াখালী, রাজবাড়ী, ফেনীতেও এমন সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে বসে নেই আওয়ামী লীগও। তারাও পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে; প্রয়োজনে বিরোধী দলকে প্রতিরোধের ঘোষণাও এসেছে। ফলে রাজনীতির মাঠে ছড়িয়ে পড়েছে উত্তাপ। সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন- কোন দিকে যাচ্ছে দেশের রাজনীতি? রাজনীতি-সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে এ উত্তাপ ততই বাড়তে থাকবে; ততই বইবে বৈরী হাওয়া। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, করোনা সংক্রমণের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরাঘাতে দেশের অর্থনীতি এমনিতেই অনেক কাবু হয়ে পড়েছে। এর ভেতর রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ইত্যাদি বেড়ে গেলে এর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের ওপর, দেশের অর্থনীতির ওপর। এ জন্য পরিস্থিতি যেন শান্তিপূর্ণ থাকে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির নেতারা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের হুশিয়ারি দিয়েছেন। গত ২০ মে রাজশাহীর পুঠিয়ার জনসভায় জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাইদ চাঁদ বলেন, ‘আর ২৭ দফা, ১০ দফার মধ্যে আমরা নাই। এক দফা শেখ হাসিনাকে করবস্থানে পাঠাতে হবে। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করার জন্য যা যা দরকার, আমরা করব ইনশাল্লাহ।’ গত রবিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকায় এক সমাবেশে বলেন, এখন থেকে শান্তি সমাবেশ নয়, সারাদেশে বিএনপিকে প্রতিরোধ করতে হবে। এ ধরনের অবস্থান নেওয়ার পেছনে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ তুলেছেন তিনি। তার বক্তব্য হচ্ছে, সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের নামে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। রাজশাহীতে দলটির এক সমাবেশে শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন ওবায়দুল কাদের। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^র চন্দ্র রায় মনে করেন, ‘জেলা বিএনপির এক নেতার মেঠো বক্তব্যকে ধরে আওয়ামী লীগ যা করছে- এটাকে রাজনীতি বলা চলে না; এটাকে স্ট্যান্টবাজি বলা হয়। এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ মূলত একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে বিএনপির শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিতে চাইছে। আমরা আগে বলেছি, গণতন্ত্র ও জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করছি। এ জন্য আমরা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছি। এখানে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগ আমাদের শত্রু না। দাবি মেনে নিলে বিএনপির আন্দোলনও করতে হবে না।’ চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনুও বলেন, আবু সাইদ চাঁদের বক্তব্য এটা দলের বক্তব্য নয়। বিএনপি সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের কঠোর প্রতিক্রিয়ার মধ্যে এক দফা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, সরকার হটানোর এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা শিগগিরই আসছে। চলমান কর্মসূচিগুলো তারই প্রস্তুতি পর্ব। এই আন্দোলনের লিখিত চুক্তি বা যৌথ ঘোষণাপত্রের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। যাচাই-বাছাই করে দলের স্থায়ী কমিটি এই ঘোষণাপত্র অনুমোদন দেবে। গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আন্দোলন সমন্বয়ের জন্য গঠিত বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘আমরা নানামুখী কর্মসূচিতে আছি। ওনারাও (গণতন্ত্র মঞ্চ) আন্দোলনে আছেন। পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতার কারণেই কিছুটা সময় যাচ্ছে। এটা (ঘোষণাপত্র) নিয়ে কাজ হচ্ছে। আশা করি, খুব তাড়াতাড়ি একটা সমঝোতার ভিত্তিতে এটা প্রকাশ্যে আসবে।’ এদিকে দলীয় নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে গতকাল বুধবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক অনুষ্ঠানে বলেন, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। যারা নির্বাচন প্রতিরোধ করতে আসবে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি বলেন, আন্দোলনের নামে বিএনপি নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস করবে, এটা তাদের পুরনো স্বভাব। উদ্ভূত পরিস্থিতি বলে দেবে কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। আর রাজনীতির একটা ভাষা আছে। রাজনৈতিকভাবে সেটা মোকাবিলা করব। আমরা সহিংসতায় যাব না। দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘বিএনপি বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। দিতেই পারেন, এটা তাদের রাজনৈতিক অধিকার। আওয়ামী লীগ এর বিপক্ষে কোনো কর্মসূচি দেয়নি, দেবেও না। নিয়মিত কর্মসূচির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের লক্ষ্য একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে যাত্রা। ফলে বিএনপি জ্বালাও-পোড়াও তাদের স্বকীয় চরিত্রে ফিরে গেলেও আওয়ামী লীগ সহিংসতায় জড়াবে না।’ দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল। সন্ত্রাসী কর্মকা- করাই তাদের কাজ। তারাই পরে সংঘাতে জড়িয়েছে বলে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। তবে আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত হলো শান্তি সমাবেশের মাধ্যমে শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে একটি সুন্দর নির্বাচনের দিকে এগোনো। কোনো প্রকার সংঘাত-সহিংসতায় আওয়ামী লীগ জড়াবে না। কিন্তু জনগণ যদি বিএনপির সন্ত্রাসী কর্মকা-কে রুখে দেয় তাহালে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কী বা করার আছে।’ সব পক্ষের কাছে আবেদন জানিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডা. মাহবুবউল্লাহ বলেন, ‘আমি সব মহলকে ধৈর্য ধারণের এবং শান্তি অন্বেষণে সঠিক পথ অনুসরণের আবেদন জানাই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সংঘাত দেশের জন্য অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তরিকভাবে আমার চাওয়া হলো সব পক্ষ যেন গণতান্ত্রিকতার বাইরে গিয়ে কোনো অবস্থান গ্রহণ না করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে দীর্ঘদিন ধরে কোনো রকম পরিসর বা স্পেস দিচ্ছিল না ক্ষমতাসীন সরকার। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে বিরোধী দলকে মিছিল-মিটিং করার সুযোগ দিচ্ছিল সরকার। এতে করে কিছুটা হলেও দেশের সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে আমিও স্বস্তিবোধ করছিলাম। অতি সম্প্রতি বিএনপির মধ্যম স্তরের একজন নেতার বক্তব্যে পরিস্থিতি আবারও সংঘাতময় হয়ে উঠেছে। এটা খুব শুভ লক্ষণ নয়। সেখানে নির্বাচন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ময়দানে কিছু উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। এই উত্তেজনার ফলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হলে দেশের জন্য অমঙ্গল সৃষ্টি হতে পারে।’ অধ্যাপক মাহবুবউল্লাহ বলেন, একজনের বক্তব্যের জন্য পুরো দলকে দোষারোপ করা হচ্ছে, এটি ঠিক নয়। এমনিতেই বড় দুই দল একে অপরকে সহ্য করতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতি তাদের মধ্যে তিক্ততা আরও বাড়াতে পারে। দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থানে গেলে সংঘাত হতে পারে এবং তা গণতন্ত্র ও দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব পক্ষকে সতর্ক থাকার পরার্মর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের আগের সময়টা সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আন্তঃদলীয় সন্ত্রাস, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে কোনো দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল থাকায় এই সুযোগ দলের মধ্যকার হিসাব-নিকাশটাও করে নিচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে আমরা চাই গণতন্ত্র বিকাশ লাভ করুক কিন্তু কোনোভাবেই যেন সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও গণতন্ত্র এক সূত্রে গেঁথে না যায়। কারণ সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও গণতন্ত্র দুটি বিপরীতমুখী বিষয়। কাজেই এ জায়গায় সরকার বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক থাকার প্রয়োজন আছে। কোনো রকম সন্ত্রাসী কর্মকা- নির্বাচনের গায়ে যেন আঁচড় না লাগে।’ বড় দুই দলের নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকার মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ তাদের মিত্রদের বক্তব্য-বিবৃতিও সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। তাদের মধ্যেও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। চলমান দ্রব্যমূল্যের র্ঊর্ধ্বগতির বাজারেও দেশের রাজনীতি বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রশ্নের শেষ নেই। তাদের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন প্রক্রিয়ায় হবে। যদিও আওয়ামী লীগের তরফ থেকে বলা হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জবাবে বিএনপি বলছে, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া দলটি নির্বাচনে অংশ নেবে না; বরং র্নির্বাচন প্রতিরোধ করবে।