নিজস্ব প্রতিবেদক:
আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুদিন ধরে জ্বালানির দাম ধীরে ধীরে কমছে। বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম আট মাসে সর্বনিম্ন। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে বাংলাদেশেও কমানো হবে। দেশে ইতিমধ্যে রেকর্ড পরিমাণ উচ্চহারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনজীবনে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম ক্রমেই বাড়ছে। গণপরিবহনে ভাড়া বেড়েছে ২২ থেকে ৩০ শতাংশ। অনেক পরিবহন সংস্থা নির্ধারিত হারের চেয়েও বেশি ভাড়া নিচ্ছে। অন্যদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে পণ্য পরিবহনের খরচ বেড়েছে, যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তাকেই বহন করতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেলের দাম আরেকটু কমে, তবে আরেকটু কমিয়ে সমন্বয় করবো। আন্তর্জাতিক বাজারের দামের সঙ্গে সমন্বয় না করার যুক্তি হিসেবে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সমপ্রতি আন্তর্জাতিক একটি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ধাপে ধাপে দাম বাড়ালে লিটার প্রতি দশ টাকা করে প্রতি মাসেই বাড়াতে হতো। এ বিষয়ে গবেষক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূলত দুটি কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সমন্বয় করা হয় না। (১) অভ্যন্তরীণ মার্কেটে মূল্য সরকার নিয়ন্ত্রিত দাম। এমনকি এলএনজি ছাড়া অন্য কিছুতে বেসরকারি খাত নেই বলে কোনো প্রতিযোগিতাও নেই। তেল আনাই হয় সরকারি প্রতিষ্ঠান বিপিসির মাধ্যমে। (২) সরকার সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে তেল ক্রয় করে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ মার্কেটে সরকার যে দাম ঠিক করে দেয়, সে দামেই ভোক্তা ক্রয় করে। আর এই দাম নির্ধারিত হয় সরকারি সিদ্ধান্তে, বাজারের প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নয়। তিনি বলেন, সরকার হয়তো গণমানুষ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কথা চিন্তা করে আন্তর্জাতিক বাজারের ওঠানামা থেকে ভোক্তাদের বাইরে রাখতে চায়। কিন্তু মাঝে মধ্যে এটা ভোক্তার জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আবার সরকার আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে তেল কেনে। আর সে চুক্তি হয় মূলত কতো জাহাজ ও লিটার তেল কেনা হবে তার ওপর। ফলে যখন যে চুক্তি হয়, সে চুক্তি অনুযায়ীই তেল পাওয়া যায়- বিশ্ববাজারে দাম যাই হোক না কেন। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হলে এখন যে দাম আছে, সেই দামে কিনলে দাম আরও কমলেও চুক্তির দামই দিতে হবে। লং টার্মে গেলে তুলনামূলক কম দামে তেল পাওয়া যায়। শর্ট টার্মে ঝুঁকি বেশি। বিশ্ববাজারে দাম তুলনামূলক কম থাকার সুবাদে ২০১৪ সালের পর থেকে বিপিসি পরবর্তী সাত বছরে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। যদিও ২০১৪ সালের আগে বেশ কয়েক বছর ক্রমাগত লোকসানের কারণে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে আবার প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১১শ’ কোটি টাকা লোকসানের কথা জানিয়েছে বিপিসি। যদিও সংস্থাটি গত কয়েক বছরের লাভ থেকে প্রায় পঁচিশ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে গচ্ছিত রেখেছে। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ফলে বিপিসি এফডিআর অক্ষত রেখে তেলের দাম বাড়িয়ে সমন্বয় করেছে আর ভোক্তাকে এখন নিজের এফডিআর ভেঙে সে তেল কিনতে হচ্ছে। এজন্য ভোক্তাকে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি তেল দিতে মাঝে মধ্যে যৌক্তিক সমন্বয়টাও দরকার। এদিকে, দেশের অর্থনীতির গতি স্বাভাবিক রাখতে ও জনস্বার্থে জ্বালানি তেলের জন্য কর প্রত্যাহার করে মূল্য পুনঃসমন্বয় করার বিষয়ে দাবি জানিয়েছে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ (এফবিসিসিআই)। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া এক চিঠিতে এই দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি। চিঠিতে সংগঠনটি বলেছে, জ্বালানি তেলের সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক চাপে ফেলবে। কৃষি, পণ্য পরিবহন, উৎপাদনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে, যা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলবে এবং জনজীবনের দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেবে। জ্বালানি তেলের ওপর বর্তমানে মোট ৩৪ শতাংশ করভার (শুল্ক ১০ শতাংশ, মূসক ১৫ শতাংশ ও অগ্রিম কর ৫ শতাংশ এবং অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ) আরোপিত আছে। তবে কর প্রত্যাহার করে জ্বালানি তেলের দাম পুনঃসমন্বয় করলে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব এড়ানো যাবে বলে সংগঠনটি মনে করে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর প্রতি লিটার অকটেনে ২৫ টাকা লাভ করছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আর প্রতি লিটার পেট্রোলে এর চেয়ে ৫ টাকা কমবেশি লাভ হতে পারে। ডিজেলে এখনো লোকসান হচ্ছে লিটারপ্রতি ৬ টাকা। গত মাসের মতো একই পরিমাণ বিক্রি হলে ডিজেল ও অকটেন থেকে এ মাসে ২০৫ কোটি টাকা মুনাফা করতে পারে বিপিসি। জ্বালানি তেলের দাম আট মাসে সর্বনিম্ন: আন্তর্জাতিক বাজারে কিছুদিন ধরে জ্বালানির দাম ধীরে ধীরে কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত মঙ্গলবার অপরিশোধিত তেলের দাম কমেছে। এদিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটরি (ডব্লিউটিআই) জ্বালানি তেলের ব্যারেলপ্রতি দাম ৩ দশমিক ২৮ ডলার বা ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ কমে ৮৬ দশমিক ১৩ ডলারে নেমেছে, যা জানুয়ারির পর এই তেলের সর্বনিম্ন দাম। অন্যদিকে ইউরোপভিত্তিক ব্রেন্ট ক্রুড জ্বালানি তেলের দামও কমেছে। একইদিনে প্রতি ব্যারেল ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ বা ৩ দশমিক ১৩ শতাংশ কমে ৯২ দশমিক ১২ ডলারে নেমেছে। এটি চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির পর থেকে ব্রেন্ট ক্রুডের সর্বনিম্ন দাম। অর্থনীতিবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোয় শিল্প, কৃষি খাতসহ সার্বিক অর্থনীতিতে যে অভিঘাত সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দেয়া কঠিন হবে। সরকারের নীতিনির্ধারকরাও বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলে বাংলাদেশেও কমানো হবে। ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। গত ৬ই আগস্ট জ্বালানি তেলের (ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন, পেট্রোল) দাম গড়ে ৪৭ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এর মধ্যে গণপরিবহন ও কৃষি খাতে বহুল ব্যবহৃত ডিজেলের মূল্য ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪, অকটেনের দাম লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ আর পেট্রোলের দাম লিটারে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ সালে মোট জ্বালানি তেলের চাহিদা ছিল প্রায় ৭০ লাখ টন যার মধ্যে অকটেনের ব্যবহার ছিল ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৬০২ টন আর পেট্রোলের ব্যবহার ছিল ৪ লাখ ৪৬ হাজার টন। দিনে গড়ে ১২ থেকে ১৪ হাজার টন ডিজেল ব্যবহার হয়, যার অধিকাংশই পরিবহন খাতে। এ ছাড়া কৃষি সেচ ও বিদ্যুৎ খাতেও ডিজেল ব্যবহৃত হয়। বছরে বিপিসির সরবরাহ করা মোট জ্বালানির ৭৩ শতাংশই ডিজেল। বছরে ৪৫ থেকে ৪৬ লাখ টন ডিজেল বিক্রি করে বিপিসি। ডিজেল ছাড়াও বিপিসি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেল, পরিবহনের জন্য অকটেন, উড়োজাহাজের জন্য জেট ফুয়েল এবং অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করে। সবমিলে দেশের মোট জ্বালানি তেলের ৬৩ শতাংশ ব্যবহার করে পরিবহন খাত। প্রায় ১৬ শতাংশ ব্যবহৃত হয় কৃষি খাতে। শিল্প খাত ৭ ও বিদ্যুৎ খাত ব্যবহার করে ১০ শতাংশ। গত ১৪ই আগস্ট রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, জ্বালানি তেলে আরও সমন্বয় করতে হতে পারে। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি তেলের দাম আরেকটু কমে, তবে আরেকটু কমিয়ে সমন্বয় করবো। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা আশাবাদী তেলের দাম কমলে সমন্বয় করে নিচে নিয়ে আসতে পারবো। অন্যদিকে গত ১০ই আগস্ট রাজধানীর কাওরান বাজারস্থ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) প্রধান কার্যালয়ে চেয়ারম্যান এ বিএম আজাদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পেট্রোল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে। বর্তমানে আগস্টের প্রথম সপ্তাহে প্রতি লিটার ডিজেলে ১২০ টাকা খরচ হচ্ছে বিপিসির, এক্ষেত্রে লিটারপ্রতি ৬ টাকার মতো লোকসান দিতে হচ্ছে। অকটেনে ২৫ টাকার মতো বিপিসি’র লাভ হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকেই বলছেন, বিপিসি’র টাকা দিয়ে কয়েক মাস চললে তেলের দাম বাড়াতে হতো না। এটা ঠিক নয়। আমরা এফডিআরের টাকা দিয়েই তেল আমদানি করেছি। ক্রুডের কারণে পেট্রোল ও অকটেনের দাম বাড়ে। সুতরাং পেট্রোল ও অকটেনের দাম কৌশলগত কারণে বাড়াতে হয়েছে। দেশে উৎপাদিত পেট্রোল ও অকটেনে মুনাফা করার বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, পেট্রোল-অকটেনের কাঁচামাল হিসেবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। কিন্তু বছরে বিপিসি’র বিক্রি করা জ্বালানি তেলের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি ডিজেল। তাই ভারসাম্য রক্ষায় অকটেনের দাম বাড়ানো হয়েছে। পেট্রোলের দাম বেশি কমানো হলে অকটেনের সঙ্গে মিশ্রণ করতে পারে। তাই পেট্রোলের দামও অকটেনের কাছাকাছি রাখতে হয়। এদিকে সরকার রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আনার বিষয়ে ভাবছে বলেও সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন। তবে তার অগ্রগতি কতোটুকুও তা জানা যাচ্ছে না।