আকাশ খবর আমার কাছে শুধুমাত্র একটা প্রতিষ্ঠান নয়। এটা আমার সন্তানতুল্য একটি সম্পদ। প্রতিষ্ঠাতা আমার বাবা। তিনি শুরু করেছিলেন ২০০৪ সালের ৪ মার্চ। ওইদিন দৈনিক আকাশ খবরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। সেক্ষেত্রে বলতে গেলে আকাশ খবরের পথা চলা ১৭ বছরে গড়িয়েছে। এবার আসা যাক আকাশ খবরের পথচলার ইতিহাসে: ২০০৪ সালের ৪ মার্চ আমার বাবা অ্যাডভোকেট তছিরুল আলম মালিক উিউকের সম্পাদনায় দৈনিক আকাশ খবরের জন্ম। ২০০৭ সালের ১৩ আগস্ট পত্রিকার ডিএফপি অনুমোদন হয়। তারপরই এক মাসের মাথায় হঠাৎ বাবার প্রথম স্ট্রোক হয়। সঙ্গত কারণেই ওইসময় তীব্র ঝড়ে দুলতে থাকা নৌকার মতো আকাশ খবর দুলছিল। এভাবে কেটেছে ২০১৩ সাল পর্যন্ত। ২০১৩ সালের ৪ মার্চ নতুন আঙ্গিকে বাজারে আসে আকাশ খবর। বাবা অসুস্থ থাকায় সম্পাদনার দায়িত্ব পড়ে আমার স্বামী তানজির আহমেদ রনি’র ওপর। আমার উপর দেয়া হয় বার্তা বিভাগের দায়িত্ব। কিছুটা ভয় কাজ করছিলো। ভাবছিলাম কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্রী হয়ে কিভাবে সাংবাদিক, সংবাদ মাধ্যম সামাল দিবো! একটা পত্রিকার বার্তা বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন মানে অনেক বড় গুরুদায়িত্ব। তখন মনে হয়েছিলো, বাবার প্রতিষ্ঠান বলেই কি উত্তরাধিকারসূত্রে এই সন্মাননা পেলাম নাকি আসলেও এই কাজের যোগ্য আমি? যাহোক, দায়িত্ব যখন পেলাম সেটা যথাযথভাবে আমাকে পালন করতেই হবে। শুরু হলো আমার সাংবাদিকতার হাতিখড়ি। বেশ ভালোই চলছিলো সবকিছু। যদিও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতায় কাটছিলো একেকটি দিন। হঠাৎ আবারও এক ঝড় এলো। যেটার জন্য আমি বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলাম না। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ আমার স্বামীর তানজির আহমেদ রনির মৃত্যু হয়। সব কিছু আবারও অগোছালো হয়ে গেলো। ভয়ে, শঙ্কিত হয়ে পরলাম। সামনের দিনগুলো কিভাবে কাটবে, কিভাবে সব কিছু সামাল দিবো। এসব ভাবনা আমাকে এলোমেলো করে দিল। সব কিছুই হয় বিধাতার ইচ্ছায়। আমি দুঃখকে সঙ্গী করে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে চলা শুরু করলাম। কঠিন বিপদের সেই মূহুর্তে বন্ধু, সহকর্মী যেটাই বলি না কেনো, পাশে এসে দাঁড়ালো চুয়াডাঙ্গার একজন প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম ডালিম। যিনি একাধারে যমুনা টিভির জেলা প্রতিনিধি, ইউএনবি, দেশ রুপান্তর, ঢাকা ট্রিবিউনের মতো প্রথমসারির সাংবাদ মাধ্যমে কাজ করতেন। তিনিই মূলত আমাকে সাহস যোগালেন। আকাশ খবরের স্ট্যায়ারিং ধরতে হবে আমাকেই! শুরু হলো আকাশ খবরের নতুন আঙ্গিকে পথচলা। কিন্তু ওইযে নিয়তি, যেটা আমার জন্য সবসময়ই ছিলো অনেক চ্যালেঞ্জের। জীবনে সবকিছুই অনেক সাধনা করে পেতে হয়েছে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মালেই যে পৃথিবীটা তার জন্য সবসময় ফুলের বিছানা হবে এটা ঠিক না। সেটা আমার জীবন দিয়ে প্রতিটা মূহুর্তে আমি উপলব্ধি করেছি স্বামীর মৃত্যু আর বাবার ব্রেইন স্ট্রোকের পর।
সবকিছুকে ভাবনায় রেখেই নতুন আঙ্গিকে আকাশ খবরের যাত্রা শুরু হলো। সম্পাদনার দায়িত্ব পড়লো আমার কাঁধে। বাবা থাকলেন মাথার ওপর প্রকাশক হয়ে। পত্রিকার সব দায়িত্ব আমার কাঁধে, ভাবতেই ভীত হয়ে যাচ্ছিলাম। এতো বড় গুরুদায়িত্ব কিভাবে সামাল দেবো। গণমাধ্যম তো গণমানুষের কথা বলে, সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলে, জনগনের সুখ, দুঃখ সকলের কাছে পৌঁছে দেয়। সেটা কি আমি পারবো? দায়িত্ব বাড়ছে সাথে সাথে ভাবনাও বাড়ছে। এসব ভাবনার সঙ্গী হয়েছিলেন ডালিম, তিনি প্রতি পদক্ষেপে কিভাবে সাংবাদিকতায় পা ফেলতে হবে তা হাতে কলমে শিখিয়েছেন। যাহোক, আকাশ খবরের সম্পাদক হিসেবে আমার পথ চলার গল্পটা সবার থেকে ভিন্ন বেশ কঠিনতর। প্রথমত মফস্বল শহর। তারপর আমি একজন নারী। সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশা, তাও আবার একেবারে সম্পাদক! এবার শুরু হলো জটিল জটিল সব সমস্যা। সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাগত রাজনীতি সবকিছুতেই বাধা। কেউ সাহায্য তো দূরের কথা, একের পর এক বাধা সৃষ্টি শুরু করলো। সেসময় আমার পরিবারের সহযোগিতা ছিলো পূর্ণরুপে। এজন্যই হয়তে আজ আমি পাঠকের কাছে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ পেলাম।
সব রকমের চড়াই-উৎরাই, প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে অবশেষে ২০২০ সালের ৭ ডিসেম্বর আবারও শুরু হলো আকাশ খবরের নতুন পথচলা। এবারের যাত্রাটা ছিলো একটু অন্যরকম এবারে আকাশ খবরের যাত্রা শুরু হলো একঝাঁক মেধাবী নবীন-প্রবীণ সাংবাদিক, যাদের কাজকে অনেকে ঈর্ষা করে, যাদের ক্ষুরধার লেখনিতে সমাজের চিত্র বদলে যায়। এরকম সব গুণী সাংবাদিকদের সহযোগিতায় আবারও আকাশ খবর পরিবারের নতুন জন্ম হলো।
৭ ডিসেম্বর আমার সম্পাদনায় পত্রিকা প্রকাশের প্রথম দিন সারারাত আমরা কাজ করলাম। পত্রিকার ট্রেসিং বের হলো ভোর সাড়ে ৪ টায়। ট্রেসিং হাতে প্রেসে যখন পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে সময় পৌঁনে ৫টা। সেখানে আরো একটি স্থানীয় পত্রিকা ছাপা হয়। সেদিন তারা ৮ পৃষ্ঠার বিশেষ সংখ্যা বের করছেন। আবারও জটিলতা, প্রথমদিন ঠিকমতো পত্রিকা বিলির জন্য বাসের ১ম ট্রিপ ধরতে হবে। হাতে সময় মাত্র ৪০ মিনিট। কিভাবে সম্ভব? যাহোক, অবশেষে পত্রিকা প্রিন্ট শেষ হলো সকাল ৮টায়। প্রথম দিন পত্রিকা ছাপা হলো ৪২৬৫ কপি। সার্কুলেশন ম্যানেজার হাসেম ভাই ৩টা ব্যান্ডেল নিয়ে চলে গেলেন। আমি আর ডালিম রাত ৪টা থেকে প্রেসে ঠাঁই দাড়ানো, তবুও ক্লান্তি নেই, একটাই টেনশন পত্রিকাটা পাঠকের কাছে কতো দ্রুত পৌঁছাতে পারবো। অবশেষে পত্রিকা প্রকাশিত হলো। খুশিতে কেঁদে দিয়েছিলাম সেদিন। পাঠকের হাতে পৌঁছাতে দেরী হবে ভেবে আমরা দুজনেই পত্রিকা বাঁধতে শুরু করলাম।
প্রথম দিনের সবথেকে স্মরণীয় যে ঘটনা সেটা হলো- প্রায় ১২০ কপি পত্রিকা আমি আর ডালিম চৌরাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে নিজেরা বিক্রি করেছিলাম। একটা কথা সেই মূহুর্তে উপলব্ধি করেছিলাম বার্তা সম্পাদক হিসাবে ৪ বছর কাজ করলেও নিজের সম্পাদনা আর নিজের এককভাবে তত্ত্বাবধায়নে পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার অনুভূতি একেবারেই আলাদা। যাক আল্লাহ’র রহমতে মাত্র কয়েক মাসেই আমরা সার্কুলেশনে দ্বিতীয় অবস্থানে পৌঁছায়। কিন্তু বারবার ভাগ্য আমাকে নিয়ে খেলছে। মাত্র ৯ মাসের মাথায় আবারও হারালাম আকাশ খবরের পূর্ণজন্মের কেন্দ্রীয় চরিত্র সাংবাদিক ডালিমকে। পায়ের তলার মাটি সরে গেলো। ডালিমের লাশের সামনে বসে ভাবছি- বার বার আমিই কেনো? আকাশ খবর পরিবারই কেনো ভাগ্য বিধাতার রোষানলে পরছে? ৭ দিনের ছুটি ঘোষনা করলাম ডালিমের শ্রদ্ধা-সন্মানার্থে। প্রথম ২ মাস আবারও অগোছালো হয়ে গেলো সব। এবার দায়িত্ব পড়লো ছোটভাই জিসানের ওপর। যে ডিবিসি নিউজ চ্যানেলের চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি, আমাদের আকাশ খবরের বার্তা সম্পাদক, ডালিমের হাতে তৈরী।
এসময়ে আবারও নতুন করে সাহস যোগালো দীপ্ত টিভির চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি কামরুজ্জামান সেলিম। আর অভিভাবক হিসাবে পাশে পেলাম অ্যাড. মানিক আকবর আঙ্কেলকে। যিনি ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি, কালের কন্ঠের জেলা প্রতিনিধি।
এতে টর্নেডোর পরেও আজ আকাশ খবর নতুন আঙ্গিকে এক বছর পূর্ণ করেছে। মহান আল্লাহ’র রহমতে হাজার ঝড়ের পরেও বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছি। হারতে আমি শিখিনি। আল্লাহর উপর বিশ্বাস রেখে সৎ সাহস নিয়ে কাজ করছি। এই এক বছরে অনেক কিছু শিখেছি, ঠকেছি, কর্মক্ষেত্রে প্রতিহিংসার শিকার হয়েছি, আবার অনেকে নিজের প্রতিষ্ঠানের না হয়েও পাশে থেকেছেন, ভরসা দিয়েছেন। এইসবকিছু মিলিয়ে এগিয়ে থাকার চেষ্টা করেছি। থেমে থাকিনি, হেরে যায়নি। পাঠকের ও শুভাকাঙ্খীদের দোয়া, ভালোবাসা আর সহযোগীতায় আকাশ খবর পরিবার যেনো আরো সামনের দিকে এগিয়ে যায় সেই দোয়া চাই সকলের কাছে।
সবশেষে কিছু মানুষের কথা বলতেই হয় যারা আমার এই পথচলাতে সব রকমের সুখ-দুঃখের সাথী হয়েছেন। তাঁদের নামটা অন্তত বলা দরকার। মানিক আকবর আঙ্কেল, সেলিম, জিসান, জনি, অনিক, লিটন এবং আরো কেউ কেউ।
আরেকটি কথা বলি, আমি সবচেয়ে বেশি সমর্থন, সহযোগিতা, পরামর্শ, এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেয়েছি আমার প্রিয় পাঠকদের কাছ থেকে। তাঁরা আমাকে প্রতিদিন উৎসাহ দেন। পরামর্শ দেন। সবকিছু দুহাতে আঁকড়ে ধরে আমি সামনের দিকে হাটছি। এখন আমার ভেতর একটা নতুন উপলব্ধি- আকাশ খবর এখন আমার আরো একটা সন্তান।
-জান্নাতুল আওলিয়া নিশি, সম্পাদক, দৈনিক আকাশ খবর।