নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঘোষণা হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। তফসিলের পর শুরু হয়েছে ভোটের ক্ষণ গণনা। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই উত্তাপ বাড়ছে ভোটের মাঠে। সর্বত্র আলোচনা কে হচ্ছেন কোন দলের প্রার্থী? সবার বিশেষ নজর ক্ষমতাসীন দলের দিকেই। কয়েকদিনের মধ্যেই চূড়ান্ত হবে দলীয় মনোনয়ন। তাই শেষ মুহূর্তে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নিতে লবিং-তদবির চালাচ্ছেন প্রত্যাশীরা।
চুয়াডাঙ্গা-১ আসনে (চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গা উপজেলা) আওয়ামী লীগের একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী মাঠ গরম করে রেখেছেন। পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দলীয় কর্মসূচি পালনে নিজেদের মধ্যে কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছেন। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ আসনে আওয়ামীলীগ ও বিএনপির মধ্যে লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি। টানা তিনবার ক্ষমতায় থেকে নতুন ঘাঁটি গড়েছে আওয়ামী লীগ। সেই আওয়ামী লীগের নৌকায় চড়তে চান অন্তত ১২ নেতা।
এক নজরে চুয়াডাঙ্গা-১: দেশ স্বাধীনের পর এ আসন থেকে বিএনপি ৫ বার, আওয়ামী লীগ ৪ বার, জাসদ (রব) ১বার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ১বার নির্বাচিত হয়েছেন। ১৯৭৩ সালের ১ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের ব্যারিস্টার বাদল রশীদ। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির মিঞা মো. মুনসুর আলী। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হন স্বতন্ত্র প্রার্থী মকবুল হোসেন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন জাসদের (রব) মোহাম্মদ শাহজাহান। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত হন বিএনপির মিঞা মো. মুনসুর আলী। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির শামসুজ্জামান দুদু। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পুনরায় নির্বাচিত হন বিএনপির শামসুজ্জামান দুদু। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির শহীদুল ইসলাম বিশ্বাস। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৮ টানা তিনবার নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন। বিগত ১১টি সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে এ আসনটি এক সময় বিএনপির দুর্গ বলে পরিচিতি ছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে।
টানা ৩ বারের এমপি ছেলুন জোয়ার্দ্দার: জেলার প্রবীণ রাজনীতিবিদ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রণাঙ্গনের নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের মেয়াদকালে চুয়াডাঙ্গায় দৃশ্যমান উন্নয়ন হয়েছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে আওয়ামী লীগের জনসমর্থনও বেড়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ আসনে রাস্তাঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, স্টেডিয়াম, হাসপাতাল, সরকারি অবকাঠামোসহ ব্যক্তি মালিকাধীন খুলনা বিভাগের একমাত্র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করেছেন বর্তমান সংসদ সদস্য। মাঠ পর্যায়ে তার জনসমর্থন রয়েছে। এছাড়া প্রায় সবকটি জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে ছেলুন জোয়ার্দ্দারই দলীয় মনোনয়ন পেয়ে আসছেন। এবারও তিনি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীর তালিকায় ১ নম্বরে রয়েছেন। তবে এ আসনে এবার মাঠে রয়েছে ডজনখানেক মনোনয়ন প্রত্যাশী। এদের মধ্যে রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও নারীনেত্রী আছেন।
মাঠে আ.লীগের ডজনখানেক প্রার্থী: নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ডজনখানেক প্রার্থী মাঠে নেমেছেন। তাদের পোস্টার ছেয়ে গেছে শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগর মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন- টানা তিনবারের এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযাদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, সদর উপজেলার তিনবারের চেয়ারম্যান জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি আশাদুল হক বিশ্বাস, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপকমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিল্পপতি দিলীপ কুমার আগরওয়ালা, জেলা পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান যুবলীগের সভাপতিমণ্ডলীর সাবেক সদস্য শেখ শামসুল আবদীন খোকন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ডা. মাহবুব হাসান মেহেদী, মাইওয়ান মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য বিশিষ্ট শিল্পপতি এম এ রাজ্জাক খান রাজ, জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার, কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম পানু, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান সুমন, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু, সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শিরিন নাঈম পুনম এবং জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি আফরোজা পারভীন। প্রত্যেকেই দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করতে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করেছেন। এলাকায় নানা ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড করে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বক্তব্য: বর্তমান সংসদ-সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনের সহোদর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন বলেন, বর্তমান সংসদ সদস্য নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে নিবিড়ভাবে দলের জন্য কাজ করছেন। নির্বাচনী এলাকা গুছিয়ে রেখেছেন। এ আসনটি আওয়ামী লীগের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। এবার মনোনয়ন পেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি ও টানা তিনবারের উপজেলা চেয়ারম্যান আসাদুল হক বিশ্বাস বলেন, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালনের সময় ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আওয়ামী লীগ যোগ্য প্রার্থী নির্বাচন করলে আমিই মনোনয়ন পাব। অন্য যারা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার আশায় সভা-সমাবেশ করছেন, তারা পাঁচ মাসের প্রজেক্ট নিয়ে মাঠে নেমেছেন। মনোনয়ন যুদ্ধ শেষ হলে মাঠ থেকে হারিয়ে যাবেন তারা। দলের হাইকমান্ড এবার চাচ্ছে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী। সে হিসাবে মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি শতভাগ আশাবাদী।
নৌকার মনোনয়ন পেতে প্রচার চালাচ্ছেন ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক উপকমিটির সদস্য দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। তিনি বলেন, আনুপাতিক হারে সংসদে ব্যবসায়ী ও সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব নেই। তাই আমি মনে করি, ব্যবসায়ী মহল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং যারা চুয়াডাঙ্গার উন্নয়ন চান, তারা আমার পাশে আছেন। তাই আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।
নৌকার আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মাইওয়ান মিনিস্টার গ্রুপের চেয়ারম্যান কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অর্থ ও পরিকল্পনাবিষয়ক উপকমিটির সদস্য এম এ রাজ্জাক খান রাজ। মনোনয়নের আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, আমি দেশের মানুষের কল্যাণ, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের মানোন্নয়নে কাজ করছি। আমি স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্বাস করি।
নৌকার মনোনয়নপ্রত্যাশী কেন্দ্রীয় কৃষক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক নাজমুল ইসলাম পানু বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের চিত্র জনগণের মাঝে তুলে ধরেছি। আশা করি, দলীয় মনোনয়ন পাব।
নৌকার মনোনয়ন প্রত্যাশী ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান সুমন বলেন, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। দীর্ঘদিন ধরে দলের জন্য কাজ করছি। নৌকার মনোনয়ন পেলে বিপুল ভোটে বিজয়ী হব বলে আশা রাখি।
জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক নঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, জনপ্রিয়তা ও যোগ্য প্রার্থী হিসাবে দল যদি মনোনয়ন দেয়, তাহলে আমার বিকল্প খুঁজে পাওয়া যাবে না।
চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র জেলা ছাত্রলীগ সাবেক সম্পাদক ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক আহ্বায়ক ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু নৌকার মনোনয়নে সংসদ-সদস্য হতে চান। তিনি বলেন, আশা করছি, শেখ হাসিনা আমাকে নৌকার মনোনয়ন দেবেন।
নৌকার মনোনয়ন চান সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ-সদস্য মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শিরিন নাঈম পুনম। তিনি বলেন, দলের দুঃসময়ে কাজ করেছি। দলের সাথে থাকতে চাই। চুয়াডাঙ্গার মানুষের সুখে-দুঃখে থাকতে চাই। এজন্য চুয়াডাঙ্গা থেকে মনোনয়ন চাই।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক জ্যেষ্ঠ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সামসুল আবেদীন খোকন বলেন, যোগ্যতার ভিত্তিতে আমি দল থেকে মনোনয়ন চাওয়ার দাবি রাখি। এজন্য এবারও মনোনয়ন চাইবো। আমি নৌকা পেলে গোটা চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের চিত্র পাল্টে দিব।
জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি আফরোজা পারভীন বলেন, নারী হিসেবে আমি অনেক আগে থেকেই মাঠে আছি। আমি দলীয় মনোনয়ন চাইবো। আমি প্রত্যাশা রাখি, একজন নারী হিসেবে আমি এগিয়ে থাকবো এবং দল আমাকে নির্বাচিত করবে।