নিজস্ব প্রতিবেদক:
প্রবাসী আয় কেনার দরে শিথিলতা দেখানোর সিদ্ধান্তের পর অস্থিরতা বাড়ছে ডলারের বাজারে। ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাফেদা ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দর ঠিক করলেও সংকটের কারণে অনেক ব্যাংকই নির্ধারিত দরের চেয়ে ১২ থেকে ১৩ টাকা বেশি দামে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে। ফলে রেমিট্যান্স সংগ্রহে ডলারের দাম উঠেছে প্রায় ১২২ থেকে ১২৪ টাকা। আর রেমিট্যান্স কেনায় খরচ বাড়ায় আমদানিতেও ডলারের দাম বাড়ছে। গতকাল আমদানিকারকদের প্রতি ডলারে গুনতে হয়েছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা পর্যন্ত। এদিকে গতকাল এবিবি ও বাফেদার এক জরুরি সভায় নিজস্ব প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্স সংগ্রহে ১১৫ টাকার বেশি দর না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নানামুখী তৎপরতার পরও শৃঙ্খলা ফেরেনি ডলারের মূল্যে। ব্যাংক কিংবা মানিচেঞ্জার কোথাও ঘোষিত মূল্যে ডলার বিক্রি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে কারসাজিরও আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের কাছে বেশি দামে ডলার বিক্রি করে দেখানো হচ্ছে কম দাম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চ থেকে দেশে ডলার-সংকট বাড়তে থাকে। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু এতে সংকট আরও বেড়ে যায়। পরে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় এবিবি ও বাফেদাকে। এরপর থেকে রেমিট্যান্স, রপ্তানি, আমদানি ও আন্তঃব্যাংক ও নগদ ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে সংগঠন দুটি। সর্বশেষ গত ৩১ অক্টোবর বিভিন্ন ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করা হয়। চলতি মাস থেকে প্রতি ডলারে ৫০ পয়সা বাড়িয়ে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের দর নির্ধারণ করা হয় ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। সেই সঙ্গে গত ২০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সভায় নেওয়া রেমিট্যান্স সংগ্রহে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার সীমা তুলে নেওয়া হয়। আর আন্তঃব্যাংক ও আমদানিতে সর্বোচ্চ ১১১ টাকায় ডলার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সূত্রগুলো বলছেন, বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে অভিন্ন দরে রেমিট্যান্স কেনার কথা থাকলেও সেটি মানছে না অনেক ব্যাংক। বরং সংকটের কারণে গতকালও এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো থেকে ১২২ থেকে ১২৪ টাকায় রেমিট্যান্স কিনেছে তারা। আর রেমিট্যান্স কেনার খরচ বাড়ায় আমদানিতেও ডলারের আনুষ্ঠানিক দর অকার্যকর হয়ে পড়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, আমদানিতে আনুষ্ঠানিক দর ১১১ টাকা নির্ধারণ করা থাকলেও তাদের গুনতে হচ্ছে ১২২ থেকে ১২৫ টাকা। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান আমাদের সময়কে বলেন, রেমিট্যান্স সংগ্রহে প্রণোদনার সীমা তুলে দেওয়ার পর বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো রেমিট্যান্সে ডলারের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কারণে বাধ্য হয়েই আমাদের বেশি দরে রেমিট্যান্স কিনতে হচ্ছে। তা ছাড়া ডলার ম্যানেজ করে দিতে আমদানিকারকদের দিক থেকেও চাপ থাকে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এবিবি ও বাফেদা যে পদ্ধতিতে ডলারের দর নির্ধারণ করে দেয়, সেটার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। আসলে রেট নির্ধারণ করে দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। এটা থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের হয়ে আসা উচিত। বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি ও স্বচ্ছতা বাড়াতে আগের মতো বাজারভিত্তিক মুদ্রাবিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় ফেরত যেতে হবে। তিনি বলেন, একটা ভীতি আছে যে বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে বাজার কোথায় গিয়ে উঠবে। তবে নিয়ন্ত্রণ রেখেও বাজারের অস্থিরতা কমানো গেছে এমনটিও নয়। বলা হচ্ছে বেশি দামে ডলার কিনতে পারবেন, কিন্তু বিক্রি করতে পারবেন না। এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাজার সুষ্ঠুভাবে কাজ করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কেননা এর মাধ্যমে অনেক ধরনের ম্যানিপুলেশন এবং দেনদরবার করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইঁদুর বিড়ালের মতো ডলারের দাম নিয়েও লুকোচুরি খেলা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, বাফেদা ও এবিবি মিলে ডলারের যে দাম নির্ধারণ করা হয়, সেই দামেই ব্যাংকগুলোর ডলার বিক্রি করার কথা। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নিয়মিত তদারকি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে রিজার্ভ থেকেও ব্যাংকগুলোতে ডলার সরবরাহ করা হচ্ছে। এদিকে গতকাল সন্ধায় এবিবি ও বাফেদার জরুরি এক সভায় প্রবাসী আয়ে নিজস্ব প্রণোদনাসহ ডলারের দর সর্বোচ্চ ১১৪ থেকে ১১৫ টাকার মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠিত ওই সভায় বিভিন্ন ব্যাংকের এমডি ও ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা অংশ নেন। জানা গেছে, বৈঠকটি সাড়ে ৬টায় শুরু হয়ে শেষ হয় পৌনে ৭টার দিকে। সংক্ষিপ্ত এ বৈঠকে শরিয়াহভিত্তিক একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বর্তমান সময়ে ব্যাংকারদের গণমাধ্যমে কোনো বক্তব্য না দেওয়ার প্রস্তাব করেন। যদিও এর পক্ষে-বিপক্ষে কেউ কিছু বলেননি।