নিজস্ব প্রতিবেদক:
অভিভাবকহীন একাধিক নেতা আর নেতৃত্বের দাপটে দ্বিধা-বিভক্তিতে ভুগছে চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী রাজনীতি। মূল দল থেকে শুরু করে সহযোগী সংগঠনের কোন ইউনিট পূর্ণাঙ্গ না হওয়ায় বিভাজন ছড়িয়েছে তৃণমূল পর্যায়ে। নির্বাচনমুখী ক্ষমতাসীন দল এখনও গুছিয়ে উঠতে পারেনি নিজেদের ঘর। নির্বাচন সামনে রেখে সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে, বলছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দায়িত্বরত নেতারা অবশ্য দাবী, কমিটি পূর্ণাঙ্গকরণের কাজ চলমান রয়েছে। তবে এর প্রভাব পড়বে না নির্বাচনে।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের কোন ইউনিটই পূর্ণাঙ্গ হয়নি। আংশিক কমিটি কিংবা আহ্বায়ক কমিটি দিয়েই চলছে সাংগঠনিক কার্যক্রম।
চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগ:
সবশেষ গত বছরের ১২ ডিসেম্বর চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুনকে সভাপতি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদকে সাধারন সম্পাদক করে পুনরায় জেলা কমিটির ঘোষনা দিয়ে যান কেন্দ্রীয় নেতারা। কিন্তু তার ১০ মাস পেরিয়ে গেলেও কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়নি। নানান জটিলতায় আটকে আছে জেলা আওয়ামী লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির অনুমোদন। তবে দ্রুতই মূল দলের এ কমিটি অনুমোদন হবে বলে আভাস মিলেছে। এ সংগঠনের উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন কমিটি সম্পন্ন হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা যুবলীগ:
নঈম হাসান জোয়ার্দ্দারকে আহ্বায়ক, জিল্লুর রহমান ও শামসুজ্জোহা হাসুকে যুগ্ম-আহ্বায়ক করে ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ২১ সদস্য বিশিষ্ট জেলা কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ। ৯০ দিনের এই কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার শর্ত ছিল। এর সাড়ে ৫ বছরে পার হলেও পূর্ণাঙ্গ হয়নি জেলা যুবলীগের সকল ইউনিটের কমিটি। সম্প্রতি জেলা যুবলীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনে জীবনবৃত্তান্ত আহ্বান করা হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা স্বেচ্ছাসেবকলীগ:
গত ২০১৮ সালের ১৩ জুলাই ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপুকে আহ্বায়ক ও মতিয়ার রহমান মতি এবং শরিফুল ইসলাম রিফাতকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ৩১ সদস্যের জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। সেই আহ্বায়ক কমিটি গঠনের টানা ৫ বছর পর চলতি বছরের ১৩ জুলাই সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটির ঘোষনা দেয় কেন্দ্রীয় নেতারা। এ কমিটিতে সৈয়দ ফরিদ আহম্মেদকে সভাপতি ও হাফিজুর রহমান হাফিজকে সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। এর ১ মাসের মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার কথাও বলা হয়। যার ৩ মাস পেরিয়ে গেছে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগ:
গত ২০১৭ সালের ২ জুন মোহাইমেন হাসান জোয়ার্দ্দার অনিককে সভাপতি ও মো. জানিফকে সাধারণ সম্পাদক করে জেলা ছাত্রলীগের ৪ সদস্যের কমিটির অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এ কমিটিতে সহ সভাপতি সাহাবুল ইসলাম ও যুগ্ম সাধারন সম্পাদক হন জাকির হুছাইন জ্যাকি। কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুই মেরুর হওয়ায় সেই কমিটি ৪ বছর ৭ মাসেও তাদের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ায় ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয় ছাত্রলীগের কমিটি। এরপর দফায় দফায় সিভি আহ্বান ও কেন্দ্রীয় নেতাদের চুয়াডাঙ্গায় আগমন ঘটে। তবুও আজ প্রায় ২ বছর নেতৃত্বশূণ্য চুয়াডাঙ্গা জেলা ছাত্রলীগ।
চুয়াডাঙ্গা জেলা কৃষকলীগ:
দীর্ঘ ১৯ বছর পর গত ২০১৭ সালের ৯ এপ্রিল জেলা কৃষকলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে নেতৃত্ব ঘোষনা ছাড়াই জেলা ত্যাগ করেন কেন্দ্রীয় নেতারা। পরে একই বছরের ১২ এপ্রিল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দারকে সভাপতি ও আসাদুজ্জামান কবিরকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে কমিটি ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ছাড়াও পরবর্তী এক মাসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেরণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর ২০২২ সালের ২ জুলাই কমিটির সভাপতি গোলাম ফারুক জোয়ার্দ্দার দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গ করে মোমিনপুর ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় কৃষকলীগের সভাপতি পদ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি দিয়ে চলছে এ কমিটি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা মহিলালীগ:
দেড় যুগ পর ২০১৬ সালের জুন মাসে সম্মেলনের মাধ্যমে কহিনুর বেগমকে সভাপতি ও নুরুন্নাহার কাকলিকে সাধারণ সম্পাদক করে দুই সদস্যের কমিটি ঘোষণা করা হয়। সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার কিছুদিন পরই কহিনুর বেগম যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। ফলে এই কমিটি ৬ বছর পার করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটির আলোর মুখ দেখাতে পারেনি। গতবছরের মে মাসে জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের ওই কমিটিকেও বিলুপ্ত ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্গে নুরুন্নাহার কাকলিকে আহ্বায়ক ও নাবিলা রোকসানা ছন্দাকে সদস্যসচিব করে ১১ সদস্যবিশিষ্ট সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির ও অনুমোদন দেওয়া হয়। চলতি বছরের ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ কমিটির ঘোষণা দেওয়ারও নির্দেশনা দেন কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগ।
জাতীয় শ্রমিক লীগ, চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখা:
দীর্ঘ এক যুগ পর গত ২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগ চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে আফজালুল হককে সভাপতি ও রিপন মন্ডলকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত কর হয়। এরপর বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা কমিটির কাজ শেষ করেছে সংগঠনটি।
তৃনমূল নেতাকর্মীদের মতে, কমিটি না থাকায় নেতাদের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। সে বিভাজন তৃণমূলেও ছড়িয়ে পড়ছে। নেতা ও নেতৃত্ব নির্ধারিত থাকলে দলের মধ্যে গ্রুপিং কোন্দল অনেকটাই হ্রাস পাবে। আর নির্বাচনের সামনে সকল সংগঠন পূর্ণাঙ্গ না হলে এ বিভাজন জিইয়ে থাকবে। ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে নির্বাচনে।
দামুড়হুদা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক হাজী সহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা ইউনিয়ন পর্যায়ের কমিটি সম্পন্ন করেছি। কিন্তু উপজেলা পর্যায়ে কমিটির কাজ পূর্ণাঙ্গ করতে পারিনি। কারণে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিই আজও সম্পন্ন হয়নি। এ জন্য আমার সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই দুর্র্বল হয়ে পড়ছি। সামনে নির্বাচন সকল ভেদাভেদ ভুলে এসব জটিলতা কাটিয়ে তুলেতে হবে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি আলাউদ্দীন হেলা বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না থাকায় আমরা ইউনিট কমিটি সেভাবে কাজের গতি পাচ্ছি না। নির্বাচন সামনে রেখে জেলা আওয়ামী লীগের কমিটির অনুমোদন দেওয়ার জন্য কেন্দ্রের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
এসব ব্যাপারে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারন সম্পাদক রিয়াজুল ইসলাম জোয়ার্দ্দার টোটন বলেন, আমাদের মধ্যে গ্রুপিং-কোন্দল নেই। তবে যেখানে কমিটি নেই সেখানে নেতৃত্ব নিয়ে বিভাজন আছে। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে আমাদের মধ্যে সকল ভুল বোঝাবুঝি আর মান অভিমানের অবসান হবে। আমাদের অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধানে বসাবসি করা হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে আমার প্রস্তুত আছি।
আর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদুল ইসলাম আজাদ জানান, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগ এক গভীর সংকট অতিক্রম করছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্র যদি যথাযথ হস্তক্ষেপ না করে তাহলে আমি জানিনা যে আওয়ামী লীগের পরিনতি কি হবে।