আবুল কাসেম ফজলুল হক:
বাংলাদেশের রাজনীতির মান উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে কেউ যদি ১৯৭৩ সাল থেকে আজ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের নির্বাচনগুলোর একটি ধারাবাহিক সমালোচনামূলক বিবরণ প্রণয়ন করতেন, তাহলে তাঁর মধ্যে বাংলাদেশের রাজনীতির অন্তঃসারশূন্যতার ও বিকারপ্রাপ্তির চিত্র ফুটে উঠত। এতে বোঝা যেত বিকারপ্রাপ্ত রাজনীতি মানুষের উন্নতির জন্য কত ক্ষতিকর।
বাংলাদেশের জনগণ চার দশক ধরে রাজনীতিবিমুখ। ভোটাভুটি সামনে নিয়ে স্বার্থান্বেষীরা লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে কিছু লোককে ভোটকেন্দ্রে আনে।
এতে জুলুম-জবরদস্তি থাকে, প্রতারণা থাকে। নির্বাচন কমিশনও পক্ষপাতের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়। এই রাজনীতি নিয়ে সমাজের নিচের স্তরের শতকরা ৮০ ভাগ লোকের কোনো উপকার হয় না। তবু চার দশক ধরে বাংলাদেশে রাজনীতি বিষয়ে একমাত্র নির্বাচন নিয়েই উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা হয়।
এবার জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে যে অচলাবস্থা দেখা যাচ্ছে, তা কোনো আকস্মিক ব্যাপার নয়। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ইত্যাদি রাজনৈতিক দলের ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতা অনুধাবন করলে বোঝা যায়, কিভাবে ক্রমিকগতিতে এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। দেশি-বিদেশি যেসব শক্তি বাংলাদেশের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে আসছে, তাদের মধ্যে ‘সদিচ্ছা’ কতটা আছে, তা-ও তলিয়ে দেখা দরকার। অন্তর্গত সদিচ্ছা বিসর্জন দিয়ে, নিছক স্বার্থান্বেষী মন নিয়ে, দেশি-বিদেশি যে লোকেরা ভালো ভালো কথা বলেন, বাংলাদেশের সামনে চলার গতিপথ নির্ধারণ করেন, তাঁরা তো বাংলাদেশকে সুপথে চালিত করছেন না।
‘মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য পাগল’, ‘মানুষ বেহুঁশ হয়ে ভোট দিতে চায়’—এসব কথা ঠিক নয়। অশুভ শক্তির দৌরাত্ম্যের মধ্যে শুভ শক্তি কী করে মাথা তুলবে, জয়ী হবে এবং জয়ী থাকবে—তা নিয়ে কর্মমুখী চিন্তা ও কাজ দরকার।
ছাত্র-তরুণদের মধ্যে দেশের জন্য ভালো নতুন রাজনীতি, ভালো নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও উন্নত চরিত্রের নতুন রাজনৈতিক দলের চাহিদা লক্ষ করি। ১৯৮০-র দশকের প্রায় শুরু থেকে কোনো অদৃশ্য শক্তি আওয়ামী লীগ, বিএনপি ইত্যাদি দলকে রাজনীতিশূন্য করে তোলার জন্য কাজ করে আসছে বলে অনুভব করি। ‘এক দফা এক দাবি—এরশাদ তুই কবে যাবি’—এই স্লোগান নিয়ে ১৯৮০-র দশকে যে রাজনীতি চলেছিল, তার মধ্যে তো কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল না।
তখন থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি নগ্ন ক্ষমতার লড়াইয়ে পর্যবসিত হয়ে আছে।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে চাই, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ইত্যাদি দলের রাজনীতি পর্যবসিত হয়ে আছে নগ্ন ক্ষমতার লড়াইয়ে। আমি আমার দেশের প্রতিটি দলেরই গুণগত উন্নতি চাই। সব দল সমান নয়, সব দলের উদ্দেশ্যও এক রকম নয়। অগণতান্ত্রিক দলের নেতৃত্বে গণতন্ত্র হয় না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বাংলাদেশের রাজনীতিএকটি কথা সবারই বুঝে দেখা দরকার যে একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনো দলই ‘ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল’ ছিল না। মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম—এগুলো ছিল মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদী দল। সাম্প্রদায়িক স্বার্থসাধনে এগুলো কর্মতৎপর ছিল। কোরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক রাষ্ট্র পরিচালনার কোনো বক্তব্য এসব দল দেয়নি। জামায়াতে ইসলামী মাওলানা মওদুদীর নেতৃত্বে কোরআন-হাদিসের নির্দেশ অনুযায়ী খোলাফায়ে রাশেদিনের অনুসরণে আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দলের ঘোষণাপত্র প্রচার করেছিল। এতে জিহাদের কথাও ছিল। তালেবান, আল-কায়েদা, আইএস ইত্যাদি দলের জিহাদের ধারণা থেকে মাওলানা মওদুদীর ও জামায়াতে ইসলামীর জিহাদের ধারণা ভিন্ন ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরে যে সময়ে জামায়াত রাজনীতি করার সুযোগ লাভ করে, তখন থেকে তিন-চার বছর পরে জামায়াত জিহাদের কথা বাদ দেয় এবং আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যও পরিমার্জিত ভাষায় ব্যক্ত করে। এই জামায়াত নিয়ে পাকিস্তান আমলেও জটিলতা ছিল। কোনো ঐক্যজোট গঠন করতে গেলেই ন্যাপ জামায়াতকে জোটে না নেওয়ার কথা বলত। আর আওয়ামী লীগ বলত, জামায়াতও সরকারবিরোধী সংগ্রামী দল, এ অবস্থায় জামায়াতকে জোটে নিলে জোটের শক্তি বাড়বে। ওই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের মতই জয়ী হয়েছে, জামায়াতকে জোটে নেওয়া হয়েছে। রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করার কার্যক্রমে আওয়ামী লীগ অনেক বেশি এগিয়ে গেছে। শেখ হাসিনা নিজেকে অত্যন্ত ধার্মিক বলে আত্মপরিচয় দিয়ে আসছেন। এখন তাঁর নেতৃত্বে সরকার প্রতি উপজেলায় মসজিদ ও ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এসব করে চলছেন। কোনো সরকার ধর্মে আন্তরিক বিশ্বাস না নিয়ে ধর্মকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করলে শেষ পর্যন্ত তার ফল অত্যন্ত খারাপ হয়। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি—কোনটি কতখানি গণতান্ত্রিক? গণতন্ত্র কী? ধর্মের নামে ভণ্ডামি আর গণতন্ত্রের নামে ভণ্ডামি, কোনটিকে ভালো বলব?
বাংলাদেশের রাজনীতির স্বরূপ বুঝতে গেলে আরো অনেক প্রশ্ন সামনে আসবে, যেগুলোর উত্তর সন্ধান করতে হবে। সে ধারায় এগোব না। এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচন আসন্ন। তা নিয়ে উত্তেজনাপূর্ণ আলোচনা-সমালোচনা চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের এই নির্বাচন নিয়ে ভীষণভাবে সক্রিয়। তারা তাদের আধিপত্যবলয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চায়। ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার রাষ্ট্রগুলোতে তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগরকে তারা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। চীন ও রাশিয়াকে তারা তাদের প্রধান বিরুদ্ধশক্তি মনে করে। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে তারা ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টির কাজে ব্যবহার করতে চায়।
পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলো এখন পরস্পরবিরোধী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। এক ভাগে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাপান; অন্য ভাগে আছে চীন, রাশিয়া ও এশিয়া, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার কয়েকটি দুর্বল রাষ্ট্র। ভারতের অবস্থান দোটানার মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলো মোটামুটি ঐক্যবদ্ধ। চীন-রাশিয়ার জোট যথেষ্ট ঐক্যবদ্ধ হয়নি। এর মধ্যে রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ চালিয়ে দুর্গতিতে পড়েছে। এখন যুদ্ধ রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সক্রিয়ভাবে ইউক্রেনকে সর্বাত্মক সহায়তা দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীরা রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়াকে শেষ করে দিতে চায়। যেভাবে যুদ্ধ চলছে, তাতে এই যুদ্ধকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলা যায়। যেকোনো সময় এই যুদ্ধ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বড় যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যুদ্ধ সম্পর্কে বারবার বলছে, এখন যুদ্ধ থামানো যাবে না, যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। জো বাইডেন নিজেকে গোটা পৃথিবীর শাসকরূপে দেখাতে চান। দুনিয়াব্যাপী জনসাধারণকে যুদ্ধবাজ যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার চেষ্টা করে যেতে হবে। এখন যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার কার্যকর চিন্তা কোনো রাষ্ট্রেই খুঁজে পাওয়া যায় না। বেশির ভাগ রাষ্ট্রেই শাসক শ্রেণির লোকেরা শুধু নিজেদের কর্তৃত্ব রক্ষার চিন্তায় ও চেষ্টায় ব্যস্ত। সর্বজনীন কল্যাণের চিন্তা তাঁদের নেই। লেনিন, মাও জেদং, ফিদেল কাস্ত্রো, হো চি মিন কী উদ্দেশ্যে রাজনীতি করতেন? জেফারসন, আব্রাহাম লিংকন, জর্জ ওয়াশিংটন রাজনীতি দ্বারা কী কামনা করতেন? মানবজাতিকে নিয়ে মহাত্মা গান্ধীই বা কী কামনা করতেন?
বাংলাদেশে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করেছিল; খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি অংশ নেয়নি। বছর দুই পরে সংসদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সদস্যরা পদত্যাগ করেন। ওই অবস্থায় রাষ্ট্রপতি এরশাদ ওই জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করে নতুন নির্বাচন দেন। ১৯৮৮ সালের ওই সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, বিএনপি—দুই দলই নির্বাচন বর্জন করে। তখন নির্বাচন হয়ে যায় ভোটারবিহীন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুই দলেরই রাজনৈতিক মান অনেক নিচে নেমে যায়। সেই ভোটারবিহীন সংসদ নির্বাচনের জন্য কি শুধু এরশাদ দায়ী? খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার নেতৃত্ব কি দায়ী ছিল না? নির্বাচন কমিশন কী করেছিল? নির্বাচন কমিশন কি সততার পরিচয় দিয়ে ফল প্রকাশ করেছিল?
এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে অবস্থা দেখা দিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধিরা ঢাকায় এসে যেভাবে নির্বাচনের গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিচ্ছেন, সরকার ও আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দল যে ভূমিকা পালন করছে, তাতে এই নির্বাচন দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতির মান কি উন্নতির দিকে যেতে আরম্ভ করবে? রাজনীতির গতিকে নিম্নমুখিতা থেকে কী করে ঊর্ধ্বমুখী করা যাবে—এই প্রশ্ন এই সব নির্বাচনের সমস্যা থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যা, অর্থনৈতিক সমস্যা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সমস্যা, বিচারব্যবস্থা ও শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা ইত্যাদি গুরুতর সমস্যাকে বিবেচনায় নিয়ে পতনমুখিতা থেকে উত্থানমুখিতায় উত্তীর্ণ হওয়ার উপায় খুঁজতে হবে এবং কাজ করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব বিপন্ন। যেভাবে বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে, ঋণখেলাপি হয়েও অনেকে যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান লাভ করে রাষ্ট্রের ও জাতির অস্তিত্বকে বিপন্ন করে চলছেন, যেভাবে তরুণদের অনেকে বিদেশে গিয়ে নাগরিকত্ব গ্রহণ করছে, তাতে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের গড়ে ওঠার এবং জাতি ও রাষ্ট্রের শক্তিমান ও সমৃদ্ধিমান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে চলছে। জনসাধারণের কি কোনো ভূমিকা আছে বাংলাদেশের এই গতিধারায়?
বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ও খেটে খাওয়া মানুষদের শ্রমের কল্যাণে গোটা মানব প্রজাতি এখন খাওয়া-পরার সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। আইনকানুন ও বিধি-বিধানকে উন্নত করে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের সব মানুষের সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করা এখন সম্ভব। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও মনের দিক দিয়ে মানুষের উন্নতি হয়নি। মানুষের নৈতিক চেতনা নিম্নগামী। যুদ্ধবিগ্রহ, যুদ্ধ জোট, যুদ্ধের অস্ত্র নির্মাণ ইত্যাদির মধ্যে নৈতিক চেতনার নিম্নগামিতার অভিব্যক্তি লক্ষ করা যায়। বেশির ভাগ রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে কায়েমি স্বার্থবাদীদের অনুকূল করে রাখা হয়েছে। আইনকানুন, বিধি-বিধান সবই সর্বজনীন কল্যাণের পরিপন্থী। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশে ‘ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ’ মানুষের কেন্দ্রীয় প্রবণতা। গরিব থেকে যারা ধনী হয়, তারাও সুবিধাবাদী ও ভোগবাদী মনোবৃত্তি নিয়ে চলে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ ইত্যাদি আদর্শকে অকার্যকর রূপ দিয়ে মানব প্রজাতির উন্নতির সম্ভাবনাকে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। বিশ্বব্যাপী জনসাধারণকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। প্রচারমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে ভোগবাদ ও সুবিধাবাদকে কায়েম রাখার কাজে। বর্তমান বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে উচ্চ পর্যায়ের শতকরা ১০ ভাগ মানুষের অনুকূলে এবং নিম্ন পর্যায়ের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের প্রতিকূলে। আজকের পৃথিবীতে সাধারণ মানুষ পরিবর্তনবিমুখ। তারা মনে করে—বর্তমান অবস্থায় আমরা কোনোক্রমে বাঁচতে পারছি, পরিবর্তন হলে অবস্থা আরো কষ্টকর হবে।
এরই মধ্যে খবর আসছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিমান আক্রমণ চালাচ্ছে। দুই পক্ষের অন্তত ছয় হাজার লোক নিহত হয়েছে। ধ্বংসলীলা অব্যাহত আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী বৃহৎ শক্তিগুলো ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে সক্রিয় আছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং ফিলিস্তিনিদের বাস্তুচ্যুত করার সময় থেকেই চলছে এই যুদ্ধ।
এই বর্বরতার অন্ত কোথায়? ফিলিস্তিনিরা কি বাস্তুচ্যুতরূপেই নিঃশেষ হবে? সাধনা ও সংগ্রামের দ্বারা পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার উন্নতি সাধন করে মানুষের জীবনকে সুখী, সুন্দর, উন্নতিশীল করা যাবে। ব্যক্তিজীবনে, সমাজে, রাষ্ট্রে ভোগের বাসনাকে চরিতার্থ করার প্রকৃষ্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার সম্ভাবনা ও সুযোগ আছে। কিন্তু তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হবে না। এর জন্য সংগ্রাম দরকার। দুনিয়াব্যাপী রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বব্যবস্থার উন্নতির জন্য নতুন চিন্তাধারা ও কর্মধারা দরকার। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের একটি উক্তি : ‘আরাম-আয়েশ ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে কখনো আমি আমার জীবনের লক্ষ্য হিসেবে গণ্য করিনি। ভোগবাদ যে নৈতিক আদর্শের কাঠামো খাড়া করে, তাকে আমি শূকরের খোঁয়াড় বলে অভিহিত করি। যেসব আদর্শ আমার জীবনপথে আলো জুগিয়েছে এবং আনন্দের সঙ্গে জীবনযাপনে সাহস জুগিয়েছে, সেগুলো হলো সহানুভূতি, সৌন্দর্য ও সত্য। সমমনা লোকদের সঙ্গে আত্মীয়তাবোধ আর বাস্তব জগতের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক না থাকলে এবং শিল্পকলা ও বিজ্ঞানের জগতের চির অধরাকে ধরার চিরন্তন চেষ্টা না থাকলে জীবন আমার কাছে অন্তঃসারশূন্য মনে হতো। গতানুগতিক জীবনধারায় মানুষ যা কিছুর জন্য প্রয়াসপর থাকে; যেমন—সম্পত্তি, ক্ষমতা, জাঁকজমক—এগুলোকে সব সময় আমার কাছে অবজ্ঞাযোগ্য মনে হয়েছে।…মধুরতম অনুভূতি আমরা লাভ করতে পারি কৌতূহলতাড়িত রহস্য সন্ধানের অভিজ্ঞতা থেকে। প্রকৃত শিল্পকলা এবং প্রকৃত বিজ্ঞানের সূচনাবিন্দুতে থাকে রহস্য উদঘাটনের মৌলিক আবেগ। এ বিষয়ে আগ্রহ যার শেষ হয়ে যায়, যে আর বিস্মিত হয় না, কৌতূহলের আনন্দে কর্মচঞ্চল হয় না, সে মৃত—তার দৃষ্টিশক্তি নির্বাপিত।’
ভোগবাদ ও সুবিধাবাদ সম্পর্কে এই দৃষ্টিভঙ্গি কি পরিহার্য নয়? আজ দরকার জীবন-জগৎ সম্পর্কে নতুন জিজ্ঞাসা, নতুন চিন্তা ও কর্মনীতি। দরকার নতুন কর্মধারা।
লেখক : বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, সাবেক অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়