আব্দুল বায়েস:
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এখন এক ক্রান্তিকাল পার করতে হচ্ছে। একদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্থিরতা; যেমন—রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ, অন্যদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘিরে মারমার কাটকাট জাতীয় অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আশঙ্কা দিগন্তে উঁকি মারছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাসুল আমরা এখনো গুনছি, বিশেষত মূল্যস্ফীতি এবং রিজার্ভের নিরিখে। দারুণ এক দুশ্চিন্তা ঘিরে রেখেছে আমাদের।
তবে সব ছাপিয়ে এখন ডলারের বিপরীতে টাকার মানে ধস এবং রিজার্ভের পতন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মজার ব্যাপার, সরকারপক্ষ বলছে আমরা খুব ভালো আছি, সব কিছু ভালো চলছে; অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ তথা সমালোচক সম্প্রদায় বলছে, গেল গেল অর্থনীতি গেল, আর মাত্র কয়েক দিন, এর মধ্যেই সব শেষ। এমন আতঙ্কের আবহ সৃষ্টির অপচেষ্টা সার্বিক পরিস্থিতি আরো নাজুক করে তুলতে পারে। তবে ডুবন্ত জাহাজটিকে আগে ডাঙায় তুলে পরে বকাবকি করা হবে বুদ্ধিমানের দৃষ্টিভঙ্গি।
অর্থাত্ বাংলাদেশের বর্তমান নাজুক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, সেদিকে নজর দেওয়া হবে এই মুহূর্তের সহিহ কাজ।
রিজার্ভের পতন ঠেকানো এখন জরুরিশীর্ষস্থানীয় দৈনিক পত্রিকাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে, ধারাবাহিকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানি ব্যয়ে লাগাম টেনেও ঠেকানো যাচ্ছে না পতন। আমদানি কমলেও ব্যাংকে ব্যাংকে সংকট থাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের জরুরি আমদানি এবং বকেয়া বিল পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে।
এর ফলে প্রতি মাসেই কমছে রিজার্ভ, যা পুরো অর্থনীতিকে নাজুক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না কমিয়ে আরো বাড়িয়েছে। জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত যত চাহিদাই আসুক, এক কর্মদিবসে ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত ছিল। এখন প্রতি কর্মদিবসে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ মিলিয়ন ডলার।
জানা যায়, ২০২১ সালের আগস্ট মাসের ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর প্রায় ২৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।
অবশ্য ইডিএফ ফান্ডের আট বিলিয়ন বাদ দিলে রিজার্ভ দাঁড়ায় প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলার, যা উদীয়মান চ্যালেঞ্জের দিকে আঙুল তোলে।
দুই.
যেকোনো দেশে রিজার্ভ অনেকটা বাড়ির ছাদে রাখা পানির ট্যাংক কিংবা চৌবাচ্চার মতো। এক দিক দিয়ে পানি প্রবেশ করবে, অন্য দিক দিয়ে বের হয়ে সেই পানি প্রাপকের চাহিদা পূরণ করবে। ঠিক যে হারে পানি বের হবে, ঠিক সেই হারে পানি প্রবেশ করলে ভারসাম্য অবস্থা বজায় থাকে, নচেত্ হয় পানি উপচে পড়ে অপচয় ঘটাবে, নয়তো বাসিন্দারা পানিবঞ্চিত হবে। আবার পানি যেমন মানুষের জীবন, রিজার্ভও তেমনি একটা অর্থনীতির জীবন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চাকাটা সচল রাখতে যেসব মালমসলা দরকার, তার বেশির ভাগ আসে বিদেশ থেকে এবং তা কিনতে হয় বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। সুতরাং বৈদেশিক মুদ্রা মজুদ না থাকলে (অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয়ের সমতুল্য) অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হতে পারে (যেমন অধুনা শ্রীলঙ্কায়)। অন্যদিকে অতিরিক্ত রিজার্ভও যে অর্থনীতিকে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে, সে বিষয়ে আপাতত দৃষ্টি না-ই বা দেওয়া হলো।
ডলার তথা রিজার্ভের দ্রুত পতন ঘটছে কেন? এর আগে, বিশেষ করে গেল দুই দশকে, কেন এমন পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়নি? সোজা কথায় এর উত্তর হচ্ছে, যে হারে চৌবাচ্চার পানি ব্যবহূত হচ্ছে, তার চেয়ে কম হারে চৌবাচ্চায় পানি প্রবেশ করছে। হুন্ডির কারণে, ইংরেজিতে বলে ইনফরমাল চ্যানেল—বিদেশ থেকে পাঠানো ডলার দেশে ঢুকছে ঠিকই তবে ব্যাংকে জমা হচ্ছে না। হুন্ডিতে ডলারের দাম সরকারি রেটের চেয়ে বেশ বেশি, ডলারপ্রতি সাত থেকে ১০ টাকা। অর্থাত্ ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশ থেকে ডলার এলে তাকে দেওয়া হবে ১০০ টাকা আর প্রেরক যদি হুন্ডির দ্বারস্থ হয়, তাহলে সে পাবে ১০৭ থেকে ১১০ টাকা। সুতরাং যত দিন হুন্ডিব্যবস্থা শক্তিশালী থাকবে কিংবা হুন্ডির বাজার রমরমা থাকবে, তত দিন সরকারি পাতে ডলার পড়বে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, আমাদের রপ্তানি আয়ও পড়ন্ত; যার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের মতো স্ফীত হচ্ছে না। দুই. আমদানি ব্যয় বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে—হোক সে যুদ্ধের কারণে কিংবা টাকার মান নিচে নামার জন্য। সরকার আমদানি নিয়ন্ত্রণে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যে যথাযথ কাজ করেনি সে বিষয়ে সমালোচনা আছে এবং অভিযোগ আছে যে ওই সব পদক্ষেপ কার্যকর হয়ে থাকলেও তা কাঁচামাল কিংবা পুঁজি পণ্যপ্রবাহ ব্যাহত করে রপ্তানিকে বাধাগ্রস্ত করেছে। আবার শুনছি যে সরকারি কর্মচারীদের জন্য কয়েক শ গাড়ি আমদানির প্রস্তাব উঠেছে। তা ছাড়া এই সংকটকালেও তো দেখা যাচ্ছে অযাচিত বিদেশভ্রমণ, বিলাসজাতীয় পণ্য আমদানি বাড়ছে বৈ কমছে না। বিভিন্ন ছুতায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশভ্রমণ আগের মতোই চলছে। এ ধরনের বিলাসজাতীয় পণ্য আমদানি এবং ‘আনন্দ সফর’, এমনকি ব্যক্তি খাতের ব্যয় নিরুত্সাহ করে ডলার সাশ্রয় করা উচিত ছিল । তিন. ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে ডলার বিদেশে রাখা এবং বিশেষত নির্বাচনের আগে বিদেশে অর্থপাচার ইত্যাদি ডলার সংকট সৃষ্টির পেছনে নিয়ামক হিসেবে শুধু কাজ করেছে বলে মনে হয় না, চলমান পতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে।
তিন.
রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখার তেমন কোনো অবকাশ নেই। রিজার্ভের পতন ঠেকানো এখন জরুরি কাজ। অধ্যাপক রেহমান সোবহান যেমন বলেন, ‘ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মিল রয়েছে, যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি নিঃসন্দেহে শ্রীলঙ্কার চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে। কারণ আমাদের বড় একটি রপ্তানি খাত আছে। সেই সঙ্গে আছে রেমিট্যান্স বা প্রবাস আয়, যা শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি। সে কারণে বিশ্বাস করি না, বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কখনো শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে।’ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রিজার্ভ যেন ১৫ বিলিয়নের নিচে না নামে। ১০ বিলিয়ন মানে লাল বাতির সংকেত।
চার.
তবে যদি নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো তাত্ক্ষণিক বিবেচনা করা যায়, তাহলে বোধ হয় পরিস্থিতি তেমন নাজুক না-ও হতে পারে। ক. ডলারের বাজারভিত্তিক দাম নির্ধারণ করে দেওয়া; খ. বিভিন্ন দেশ বা সংস্থার পাইপলাইনে থাকা সাহায্য বা অনুদান দ্রুত অবমুক্ত করার ব্যবস্থা করা; গ. ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে প্রবাস আয়ের অন্তর্মুখী প্রবাহ বাড়ানো; ঘ. পণ্যের বহুমুখিতার মাধ্যমে রপ্তানি আয় বাড়ানো এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কড়া নজরদারিতে আমদানি-রপ্তানি রাখা, যাতে আন্ডার এবং ওভার ইনভয়েসিং না হতে পারে এবং দেশ থেকে অর্থপাচার ঠেকানোর কৌশলের সন্ধান করা।
পাঁচ.
বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ইতিবাচক প্রাক্কলন এবং ভালো ফলনের জন্য হয়তো আগামী আমন পর্যন্ত চাল আমদানি করা লাগবে না—এমন সংবাদ আশার বাণী বয়ে আনে বৈকি। এর বিপরীতে সদ্য শুরু হওয়া ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো নাজুকতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। আরো একটি সুসংবাদ এই যে আইএমএফ প্রদেয় ঋণের বিপরীতে কিছু শর্ত পূরণে বাংলাদেশকে আরো কিছু সময় দিয়েছে অর্থাত্ বেদনাসুলভ সংস্কার কর্মসূচি নির্বাচনের আগে নয়, পরে করতে আগ্রহী সরকার।
প্রসঙ্গত বলা যায় যে অস্ত্রোপচার প্রলম্বিত করলে রোগ নিরাময় হয় না, বরং ব্যাধিটি সর্বাঙ্গে বিস্তার লাভ করার সময় পায়। আমরা বালুর মধ্যে মুখ গুঁজে মনে করি তুফান শেষ। আসলে বাংলাদেশের সমাজবিজ্ঞানীদের, এমনকি আইএমএফের সুপারিশকৃত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। মূলত সংস্কারমূলক নীতিমালা গ্রহণে অনীহা আজ অর্থনীতিকে খাদের কিনারে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আশা করব, আগামী সরকার সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে। নতুবা ‘এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে…।’
লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যাল