নিরঞ্জন অধিকারী:
শক্তির দেবী দুর্গাসাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে, সৃষ্টির মূলে রয়েছে পুরুষ ও প্রকৃতির সংযোগ। চৈতন্য ও শক্তির মিলন। সনাতন ধর্মদর্শনে বলা হয়েছে, ব্রহ্ম জগৎ সৃষ্টির কারণ, আবার সৃষ্টির মধ্যেও ব্রহ্ম রয়েছেন। ব্রহ্মই পরমাত্মা, আবার ব্রহ্মই জীবাত্মা।
পরম ব্রহ্মের প্রকাশক্ষমতা বা শক্তি বা সমগ্র শক্তিই আত্মারূপে জীব ধারণ করে। শক্তি একই সঙ্গে ব্রহ্মের স্বরূপ ও রূপ দুই-ই। সগুণ ও নির্গুণ দুই-ই। সাকার ও নিরাকার ব্রহ্মের উভয় রূপের মধ্যেই শক্তির অবস্থান।
অন্তরে শক্তির এই উপলব্ধি সৃষ্টিক্ষমপ্রজ্ঞা-মণ্ডিত কবির বা শিল্পীর ভাবস্বরূপ। আর এই ভাব যখন শিল্পীর কল্পনা প্রতিভার সাহায্যে রূপলাভ করে ভাষা বা কোনো বস্তুর (প্রস্তর, কাষ্ঠ, মৃত্তিকা, ধাতু প্রভৃতি) মাধ্যমে, ‘শক্তি’ তখন প্রতীক বা প্রতিমা। দেবী দুর্গা এভাবেই ঋষিকল্পনায় উপলব্ধ, তারপর তাঁর বাণীময়-বাঙময় রূপ ‘মন্ত্র’-এর
স্বরূপে প্রকাশিত। মন্ত্রের মধ্যে যে প্রতীকী ব্যঞ্জনা, যে চিত্রকল্প বা ইমেজ, তা-ই বস্তুগত তথা দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতিমা রূপে বিনির্মিত।
শ্রীশ্রী চণ্ডী গ্রন্থে এই সত্য কাহিনি বা উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে বর্ণিত ও ব্যাখ্যাত হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রাচীনকালে একবার মহিষাসুর নামে এক অসুর দেবরাজ ইন্দ্রের স্বর্গরাজ্য অধিকার করেছিল এবং দেবতাদের বিতাড়িত করেছিল স্বর্গরাজ্য থেকে। তখন-
‘স্বর্গান্নিরাকৃতাঃ সর্বে তেন দেবগণা ভুবি।
বিচরন্তি যথা মর্ত্যা মহিষেণ দুরাত্মনা\
(শ্রীশ্রী চণ্ডী, দ্বিতীয় অধ্যায়, শ্লোক-৭)
-সেই দুরাত্মা মহিষাসুরের দ্বারা বিতাড়িত দেবগণ মর্তাবাসী মানুষদের মধ্যে পৃথিবীতে বিচরণ করতে লাগলেন।
পরাজিত দেবগণ প্রথমে ব্রহ্মার কাছে গেলেন।
তাঁকে অগ্রবর্তী করে গেলেন বিষ্ণু ও শিবের কাছে। দেবতাদের নিগ্রহের কথা শুনে অতিক্রুদ্ধ বিষ্ণু, শিব আর ব্রহ্মার বদন থেকে মহত্ তেজ নির্গত হল। একই সঙ্গে-
‘অন্যোষাঞ্চৈব দেবানাং শক্রাদীনাং শরীরতঃ।
নির্গাতং সুমহত্তেজস্তচ্চৈক্যং সমগচ্ছত\
(শ্রীশ্রীচণ্ডী, ২/১১)
-ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবগণের শরীর থেকে সুমহত্ তেজ নির্গত হল এবং সেই তেজ একই সঙ্গে মিলিত হল।
সেই পুঞ্জিত তেজ থেকে সম্মিলিত শক্তি থেকে আবির্ভূত হলেন দেবী দুর্গা। এই দুর্গা দেবী মহিষাসুরকে সসৈন্য বধ করলেন এবং দেবরাজ ইন্দ্রসহ দেবগণ পুনরায় স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেন। সুতরাং দেবগণের সবার শক্তির সংহত বা মিলিত রূপই দেবী দুর্গার প্রতিমায় প্রকাশিত। কবি-কল্পনায় বা ধ্যানে যুদ্ধরত দেবীর রূপ ধরা দিয়েছে এভাবে
ওঁ জটাজুট সমাযুক্তামর্ধেন্দুকৃতশেগরাম্।
লোচন-ত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্\
অতসীপুষ্পবর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম।
নবযৌবনসম্পন্নাং সর্বাভরণভূষিতাম্\
তাঁর দশ হাতই তো সর্বতোমুখী শক্তির প্রতীক। বিভিন্ন হাতেই তো রয়েছে ত্রিশূলাদি নানা প্রকার অস্ত্র। শত্রুবিনাশের উপায়-উপকরণ। সমন্বিত শক্তির প্রতীক বলেই দেবী নানা রূপে প্রকাশিত। যেমন—দুর্গা, কালী, চণ্ডী প্রভৃতি। আমরা জানি, প্রাচীনকালে ভারতবর্ষ ছাড়াও মিসর, পশ্চিম এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, চীন, জাপান প্রভৃতি স্থানে শক্তিপূজার প্রচলন ছিল। বিভিন্ন দেশে ও কালে শক্তির দেবী কল্পনাতেও রয়েছে ভিন্নতা ও বৈচিত্র্য। মহিষমর্দিনী দুর্গা শক্তির একটি রূপকল্পনা মাত্র।
আবার দেবী দুর্গাকে বাঙালি হিন্দু তার ঘরের মেয়ে করে নিয়েছে। মেয়ে যেন ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি এসেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে। মা-বাবার তাতে কত আনন্দ। বাঙালি কবির আগমনী গানে তার এই বাৎসল্যসিক্ত অনুভূতির সাবেগ প্রকাশ-
‘গিরি আমার গৌরী এসে বসেছে
রূপে ভুবন আলো হয়েছে।
. . . . . . . . .
ভোলানাথ আসবে নিতে-দশমীতে
এখনই ভাবিতেছি তাই মনে।
(আমার) আঁধার ঘরে উজ্জ্বল মানিক
ছেড়ে দিব কোন পরাণে?
(রামচন্দ্র মালী)
মেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে কষ্ট পায় অন্তত বাপের বাড়ির মতো সুখ পায় না—মা-বাপের আদর-যত্ন পায় না বলেই মায়ের ধারণা। ধারণা কেন, তার বিশ্বাস।
তাই মা বলে—‘এলে কি উমা চন্দ্রমুখী, আর তোমারে যাইতে দিব না।
উমা কন্যাদানের ফল কি কেবল, নয়ন জল আর কু-ভাবনা।
(অজ্ঞাত কবির রচনা।)
মা তাই সিদ্ধান্ত নেয়, তার মেয়ে উমাকে আর শ্বশুরবাড়ি পাঠাবে না। স্বামী ‘গিরি’কে জানায়,
‘গিরি, এবার আমার উমা এলে আর উমা পাঠাব না।
বলে বলবে লোকে মন্দ কারো কথা শুনব না।
যদি এসে মৃত্যুঞ্জয় উমা নেবার কথা কয়,
এবার মায়ে-ঝিয়ে করব ঝগড়া জামাই বলে মানব না\’
(রামপ্রসাদ)
কিন্তু তা তো হয় না। জামাই নিতে এলে মেয়েকে চোখের জলে ভেসে শ্বশুরবাড়ি পাঠাতেই হয়। দেবী দুর্গাকে তাই আমরা নানা রূপে দেখি। তিনি মহাশক্তি, ব্রহ্মণস্বরূপিণী, আবার বিপদগ্রস্ত শরণাগত ভক্তের কাছে তিনি দুর্গা, দুর্গতি থেকে ত্রাণকারিণী, আর সন্তানবৎসল পিতা-মাতার কাছে বিবাহিতা কন্যা দারিদ্র্যপীড়িত এবং স্বামীটিরও সংসারে মন নেই।
বিচিত্র শক্তির দেবীর রূপ, বহুমাত্রিকতায় মণ্ডিত তার স্বরূপ। দর্শনে, ইতিহাসে, উপাখ্যানে আর কাব্যে একই শক্তির সুষমাময় প্রতীকী রূপ আর তার ভাবগম্ভীর ও ভাবগভীর স্বরূপ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের অনারারি অধ্যাপক এবং বিশ্বধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের খণ্ডকালীন ফ্যাকাল্টি