বিধান চন্দ্র দাস:
মহাকবি কালিদাসের ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম্’ নাটকের মূল বিষয়বস্তু হচ্ছে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার প্রণয়। তবে এই প্রণয় কাহিনির বাইরে কবি তাঁর এই অনবদ্য নাটকে প্রাণী আর মানুষের ভালোবাসাকেও নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রথমত, বন-মধ্যে পরিত্যক্তা এক কন্যাশিশুর ‘শকুন্ত’ (পাখি) দ্বারা রক্ষা পাওয়া এবং সেই কারণে তার ‘শকুন্তলা’ নামকরণ এবং দ্বিতীয়ত, শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রাকালে তার প্রিয় হরিণশিশুটি মুখ দিয়ে আঁচল টেনে ধরে তার যাত্রা বন্ধ করার করুণ চেষ্টার বর্ণনায় প্রাণী আর মানুষের ভালোবাসা মূর্ত হয়ে উঠেছে। কণ্বের তপোবনে পশুপাখির নির্ভয়ে বসবাস করার এবং আশ্রমবাসী সেই সব প্রাণীকে সন্তানস্নেহে প্রতিপালনের অপূর্ব বর্ণনায় কালিদাস প্রাণী আর মানুষের মধ্যে ভালোবাসার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। প্রাণী আর মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে। মানব সৃষ্টির প্রাক-উদ্ভাস মুহূর্তেও সেই দ্বন্দ্ব ছিল। তবু সেই দ্বন্দ্ব আর ভালোবাসার মধ্যেও দীর্ঘকাল একটি ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছিল। কিন্তু আধুনিক মানুষের মধ্যে প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে হিংসাটাই প্রধান হয়ে উঠেছে।‘প্রাণীদের কোনো ভাষা নেই, তাদের কোনো বুদ্ধি নেই, তাদের বিচারশক্তি নেই, তারা বোধশক্তিবিহীন’—এ ধারণাই মূলত প্রাণীর প্রতি হিংসা, প্রাণীর প্রতি অবিচার এবং প্রাণীর প্রতি অবহেলার জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থা পরিবর্তনের জন্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে একক কিংবা সংঘবদ্ধভাবে অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আধুনিককালে প্রাণী কল্যাণের বিষয়টিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রায় ১০০ বছর আগে ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ, জার্মান লেখক, প্রকাশক ও সম্পাদক এবং প্রাণী প্রেমিক হাইনরিচ জিমাম্যানের (১৮৮৭-১৯৪২) নেতৃত্বে বার্লিন শহরে প্রথম ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ পালিত হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করে।
পরে ১৯২৯ সালে এই দিবসটি পালনের জন্য প্রতিবছর ৪ অক্টোবর নির্ধারণ করা হয়। প্রথম দিকে এই দিবসটি মাত্র চারটি দেশের (জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া) মধ্যে পালিত হলেও হাইনরিচের অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে অনুষ্ঠিত ‘বিশ্ব প্রাণী রক্ষা সংস্থা’র সম্মেলনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী ৪ অক্টোবর বিশ্ব প্রাণী দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেই থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ‘নেচারওয়াচ ফাউন্ডেশন’ বিশ্ব প্রাণী দিবস পালনের বিষয়টি সমন্বয় করছে। বিশ্ব প্রাণী দিবসের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী প্রাণীদের কল্যাণ এবং অধিকারের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টি ও তা বৃদ্ধি করা।
প্রাণীদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করা।
এ বছর বিশ্ব প্রাণী দিবসের (৪ অক্টোবর ২০২৩) প্রতিপাদ্য করা হয়েছে, ‘বড় কিংবা ছোট, সব প্রাণীকেই ভালোবাসো’ (গ্রেট অর স্মল, লাভ দেম অল)। এ এক অসাধারণ প্রতিপাদ্য। কারণ দেখা গেছে, কোনো কোনো দেশে বেছে বেছে শুধু বড় বড় বিভাময় প্রাণীকে (হাতি, বাঘ, পাখি, ডলফিন ইত্যাদি) রক্ষার ব্যাপারে যাবতীয় কর্মকাণ্ড নির্বাহ করা হয়। বিষয়টি একেবারেই অবৈজ্ঞানিক। কারণ পৃথিবীতে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত প্রাণীর মধ্যে বড় বড় প্রাণী, যারা সাধারণত মেরুদণ্ডী প্রাণী (স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মাছ) বলে পরিচিত, তারা মাত্র ৪.৬৬ শতাংশ। বাকি ৯৫.৩৪ শতাংশ প্রাণী সাধারণত ছোট এবং তাদের অমেরুদণ্ডী প্রাণী বলে অভিহিত করা হয়। প্রকৃতপক্ষে এসব ছোট প্রাণীর বিশাল অংশের সেবার দ্বারাই রক্ষা হচ্ছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। প্রত্যক্ষভাবে তাদের সাহায্যেই আমরা পাচ্ছি আমাদের খাদ্যের বিশাল অংশ। যেমন—২০ হাজার প্রজাতির মৌপতঙ্গ না থাকলে আমরা প্রায় আমাদের ৭০ শতাংশ শস্য পেতাম না। বড় প্রাণীদের বেঁচে থাকাও অনেকটা নির্ভর করছে এসব ছোট অমেরুদণ্ডী প্রাণীর ওপর। এরা না থাকলে যে আমরা বাঁচতে পারব না—এই চরম সত্যটি অনেকে বুঝতে চায় না। সে কারণেই এবারের বিশ্ব প্রাণী দিবসের প্রতিপাদ্যে ছোট কিংবা বড় সব ধরনের প্রাণীকে ভালোবাসতে, অর্থাত্ তাদের রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে ওয়াইল্ডলাইফ তথা জীববৈচিত্র্য, যা-ই বলা হোক না কেন, অনেকে তার অর্থ বোঝে বড় বড় বিভাময় প্রাণী। কিছু ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশে ওয়াইল্ডলাইফ তথা জীববৈচিত্র্য সংক্রান্ত প্রায় সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় এদের ঘিরে। ফলে বাংলাদেশের ৯৬ শতাংশ প্রাণী সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই নেই। ধারণা রাখার প্রয়োজনও মনে করছি না। দেশের প্রায় সব মহলের আলোচনা, লেখা, টক শো, প্রামাণ্যচিত্র, ক্রোড়পত্র, ব্যানার, ফেস্টুন ইত্যাদির বেশির ভাগ দখল করে থাকে বড় বড় বিভাময় প্রাণী। কয়েকটি পাখি, স্তন্যপায়ী, সরীসৃপ আর উভচর প্রাণীর ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে কিংবা টেলিভিশনে দেখিয়ে অনেকে ভাবছি—দেশের সব প্রাণী রক্ষা করছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘থোড় বড়ি খাড়া’ আর ‘খাড়া বড়ি থোড়’ ধরনের প্রতিবেদন তৈরি করে অথবা নিম্নমানের জার্নালে এদের ওপর লেখা ছাপিয়ে সেগুলোকে গবেষণা বলে চালিয়ে দিচ্ছি। হাততালিও মিলছে। বাংলাদেশের প্রাণীবৈচিত্র্য রক্ষা করতে হলে এই প্রবণতা বন্ধ করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে এগোনো দরকার। পাশের দেশ ভারতের কথাই যদি ধরা যায়, তাহলে দেখা যাবে যে সেখানকার প্রাণী রক্ষায় সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেখানে ‘জুয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ নিরলসভাবে মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী—উভয় গ্রুপের প্রাণীদের ওপর কাজ করছে।
শুধু বড় বড় বিভাময় প্রাণীকে রক্ষা করার দর্শন নৈতিকতার দৃষ্টিতেও সঠিক নয়। অতীতে প্রাণীর কল্যাণ বা প্রাণীর প্রতি নৈতিক ব্যবহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ছোট প্রাণীদের (অমেরুদণ্ডী) বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে গবেষণালব্ধ কোনো তথ্য ছিল না। ফলে এদের প্রাণী এথিকসের বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু বিগত কয়েক বছরে অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের ওপর গবেষণায় এদের অনেক সদস্যের মধ্যে বুদ্ধিমত্তা তথা সংবেদিতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, প্রাণী রক্ষা বা এদের অধিকার বিষয়ে যাঁরা কাজ করেন কিংবা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আছেন, তাঁদের অনেকের মধ্যে অমেরুদণ্ডী প্রাণী সম্পর্কে এখনো সেই পুরনো ধ্যান-ধারণা বিদ্যমান। গবেষণায় অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা, স্মৃতিশক্তি, প্রশিক্ষণগ্রহণ ক্ষমতা, ব্যক্তিক অভিজ্ঞতা, সংবেদিতা, ব্যথা ও অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা ইত্যাদি থাকার বিষয়গুলো এখন সন্তোষজনকভাবে প্রমাণিত। কাজেই প্রাণী কল্যাণের ব্যাপারে মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী—উভয় গ্রুপের প্রাণীদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ আইন, ২০১৯-এ সব ধরনের প্রাণীর, বিশেষ করে সব অমেরুদণ্ডী প্রাণীকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি [(অনুচ্ছেদ ২(১১) (অ-উ)]। এই আইনটি মূলত প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা প্রতিরোধ করা, সদয় আচরণ প্রদর্শন করা ও দায়িত্বশীল প্রতিপালনের মাধ্যমে প্রাণীর কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্য হলেও এর কিছু ধারার সঙ্গে প্রাণী কল্যাণ দর্শন সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন—‘প্রাণীর প্রতি অপ্রয়োজনীয় নিষ্ঠুর আচরণ’ বলে গণ্য করার জন্য যে অনেক ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, তার মধ্যে একটিতে প্রয়োজনে প্রাণীকে প্রহার করার ইঙ্গিত আছে [‘প্রাণীকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করানো বা অপ্রয়োজনীয়ভাবে প্রহার করা হয়’ : ধারা ৬ (১)(খ)]। আইনটিতে এ ধরনের আরো কিছু বিষয় প্রাণী কল্যাণের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রাণী কল্যাণের সঙ্গে প্রাণী গবেষণার বিষয়গুলোও জড়িত। বাংলাদেশ প্রাণী কল্যাণ আইন, ২০১৯-এ গবেষণা কিংবা শিক্ষাকাজে প্রাণীদের ওপর নিষ্ঠুরতা করা যাবে—এমনই একটি ধারণা পাওয়া যায় [৬(৪)ঙ]। এ কথা ঠিক যে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য অনেক সময় প্রাণীদের কষ্ট দেওয়া কিংবা হত্যার প্রয়োজন পড়ে। তবে উন্নত দেশগুলোতে তার জন্যও নীতিমালা আছে। সেই ধরনের নীতিমালা আমাদেরও করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের প্রাণীদের কল্যাণ এবং অধিকার নিশ্চিত করার প্রথম শর্ত হচ্ছে, এদের সবাইকে (ছোট-বড়) রক্ষার জন্য কার্যকরভাবে চেষ্টা করা। আর তা করতে গেলে এদের সবাইকে নথিভুক্তকরণ এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। এ জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে অগ্রসর হওয়া দরকার। সাময়িক প্রকল্প করে এ কাজ করা যাবে না। ২০২২ সালে মন্ট্রিয়লে (কানাডা) অনুষ্ঠিত ‘কপ-১৫’ (কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ টু দ্য ইউএন কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি)-তে বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টিকে আন্তরিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় দেশে কার্যকর অবকাঠামো (ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, জীববৈচিত্র্য গবেষণা কেন্দ্র, জুয়োলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ ইত্যাদি) তৈরি করা এখন সময়ের দাবি। সেই সঙ্গে দেশে প্রাণীর কল্যাণ ও প্রাণীর অধিকার বিষয়ে গণসচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করা প্রয়োজন।
লেখক : উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এবং অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়