পিটার এফ. ড্রাকার বলেন, “লিডার শুধুমাত্র একজন ম্যাগনেটিক পার্সোনালিটি সম্পন্ন ব্যক্তি নয়, যিনি অনর্গল বক্তব্য দিতে পারেন, শুধুমাত্র বন্ধু তৈরী বা মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকলে হল না; তাকে মানুষের দৃষ্টিকে আরও উঁচু করাতে হয়, মানুষের পারফরম্যান্সকে আরও বৃদ্ধি করাতে হয়, মানুষের ব্যক্তিত্বকে সাধারণ সীমার বাইরে নিতে হয়।”
লরেল নামীয় এক মহিলা তার কোম্পানীর প্রেসিডেন্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে কাজ করতেন। তিনি বোর্ড মিটিং থেকে শুরু করে সমস্ত ধরণের মিটিং এ উপস্থিত থাকতেন, কখনো কথা বলতেন না। নিজেকে নিরব পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় রাখতেন। সব সময় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে থাকার কারণে নিজ কোম্পানীর সবাইকে যেমন ভালভাবে চিনতেন, তেমনি অন্যান্য কোম্পানী বা অফিসগুলো সম্বন্ধে তার ভাল ধারণা গড়ে ওঠে। বিভিন্ন উৎসবে বা অনুষ্ঠানে তিনি তার প্রেসিডেন্টের পক্ষ্য থেকে শুভেচ্ছা বা ম্যাসেজ বিনিময় করতেন। নিজের চোখের সামনে ভাল-মন্দ অনেক কিছু ঘটতে দেখেছেন। হঠাৎ একদিন সিনিয়র লিডারদের মিটিং এ একটা বিষয়ে ফাইনাল সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে-এমন একদিনে-এমনি এক সময়ে-শ্রমিক স্বার্থ নিয়ে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ¦ শুরু হলো। নতুন করে সিদ্ধান্ত গ্রহন তো দুরের কথা-পারস্পরিক বিবাদ শুরু হবার উপক্রম, এক সাথে সবাই কথা বলা শুরু করলো। পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলো, এমন সময়, পিছনে বসে থাকা লরেল উঠে দাঁড়ালেন এবং ঐ বিষয়ে পরামর্শ দিলেন যে- শ্রমিকদের যে অভিযোগ বা দাবী-দাওয়া রয়েছে-তার মধ্যে কিছু ভাল দিক থাকতে পারে। আমরা বিবাদ না করে, সময় নষ্ট না করে-শ্রমিক প্রতিনিধিদেরকে এখানে উপস্থিত করতে পারি। যে কথা সেই কাজ, শ্রমিক প্রতিনিধি এসে গেল, শ্রমিক প্রতিনিধি যা বললো, সিনিয়র ম্যানেজমেন্টও তাই করতে চেয়েছিল। এখানে লরেল জানতেন-শ্রমিকরা লিডারদের চেয়ে ‘ওয়ার্ক ফ্লো’ সম্বন্ধে ভাল বলতে পারবে, কেননা তারা সেই কাজটা করে। লরেল চেয়েছিল-উদ্ভুত সমস্যার সমাধানটি শ্রমিকদের চোখে দেখতে।
রোয়েনা বললো, “আজ তোমার আলোচ্য বিষয় কি? তুমিই তো বলো-আগে লক্ষ্য ঠিক করতে। তা না হলে-কোন কাজেই সফল হওয়া যায় না। আমার তো মনে হচ্ছে-তুমি ‘বার্গেনিং’(তর্ক/ঝগড়া) নিয়ে কথা বলবে।” আমি বললাম, “গল্প শুনে শুনে তোমার অনেক ইম্প্রুভমেন্ট এসেছে। আজকের বিষয়-বার্গেনিং নয়, লরেল নামের মহিলা- “দ্যা ফলোয়ার”। কাজ নেই, শুধু পর্যবেক্ষন করা এবং প্রেসিডেন্ট সাহেবকে ফলো করা। রোয়েনা বললো, “আচ্ছা ফলোয়ার কখনও লিডার হয়? নাকী সারা জীবন ফলোয়ারই থেকে যাবে?”
মেয়ের প্রশ্নের সূত্র ধরে বললাম, “খেয়াল করে দেখো উল্লেখিত ঘটনায় লরেল চুপ থাকেনি। পথ দেখিয়েছে। ঐ দিন কথা বললেও পরে আর কখনো কোন কথা বলেনি। প্রকৃতপক্ষে-আজকের লিডার কিন্তু লরেল। শুরুতে প্রিটার এফ. ড্রাকারের বক্তব্য তুলে ধরেছিলাম-তার সাথে লরেলকে মিলিয়ে দেখ। লরেল ফলোয়ার বলে তার যে লিডার হবাব সুযোগ নেই-তা কিন্তু নয়। প্রশ্নটা হলো, “হোয়েন শুড আই ফলো?”
আমরা বুদ্ধি জাগা থেকে শুনে আসছি-আমাদের জন্মই হয় নেতৃত্ব দেবার জন্য। কিন্তু একটু বড় হয়ে যখন বাড়ীর দরজার চৌকাঠ পার হতে শুরু করেছো -তখন অন্য দশজন মায়ের মতো- তোমার আমার মা ও বলে দিয়েছে-“টু বি এ ফলোয়ার। ”এর কারণ জানতে তোমাকে ভেনিজুয়েলার আর্মি ক্যাম্পের সাইন বোর্ডের লেখাটা শুনতে হবে।-“ইউ ইউল লিড, সো লার্ন ইউ টু ফলো।” তুমি কখনোই অন্ধ ফলোয়ার হবে না। তোমার নেতাও চান-তুমি জেনে বুঝে ও চিন্তা করে তাকে ফলো করো। লরেল যেমন তার নেতাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন-এমনটাই সফল নেতা চান। তোমাকে মনে রাখতে হবে-প্রত্যেকটা বসের ও কিন্তু বস আছে। এটা একটা ট্রাজেডি। এই অর্থে প্রত্যেকেই ফলোয়ার। অনেকে মনে করেন-ফলোয়ার হলে কাজ বা দায়িত্ব কমে যায়। এখানেই ঘটে বিপত্তি। ফলোয়ার হয়েও যে সকল বিষয়কে গভীরভাবে নেয়-সেই মূলত ‘ছোট লিডার’। স্বাভাবিকভাবে আমরা আরও মনে করি- ফলোয়ার সব সময় ঘাড় নিচু করে রাখবে, সব সময় নেতার কমান্ড ফলো করবে । অফিস আদালতে ফলোয়ারকে আবার ‘সাব অর্ডিনেট’ বলা হয়। তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া বা প্রভাবিত করার সক্ষমতার বিষয়টা অফিস প্রধানরা ভাল চোখে দেখেন না । কিন্তু ইফেকটিভ ফলোয়ার ব্যতিত কোন নেতা সফল হতে পারেন না। তাই ইফেকটিভ ফলোয়ারদের জন্য নেতার বানী হলো ‘গো’। এই ‘গো’ স্বাধীনতা ও ইনস্পাইরেশন মিশ্রিত একটা সিরাপ যা দিয়ে-ফলোয়ার এবং নেতার দুরুত্ব নিমিষে ঘুচে যায়।
রোয়েনা তখন জানতে চাইলো তাহলে-এক্ষেত্রে তো নেতার ভূমিকা থাকবে বেশী। নির্দিষ্ট করে বলতে বললে- একজন নেতার ফলোয়ারদের প্রতি কি কি বিষয়ে খেয়াল রাখা জরুরী। আমি বললাম-১. একজন নেতার কার্যক্রমে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। কেননা নেতা ও ফলোয়ারের মধ্যে সবথেকে যে জিনিসটা ঘাটতি তাহলো পারস্পারিক আস্থা ও বিশ^াস। ২. গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় বিষয়-সেটা হলো নেতার উন্নতি (পরবর্তী ধাপে যাওয়ার) করার ইচ্ছা। কন্টিনিউয়াস ইম্প্রুভমেন্ট ও লার্নিং প্রসেস চালু থাকতে হবে। ৩. ফলোয়ারকে ইনস্পাইয়ার এবং ইমপাওয়ার করা। পজেটিভ হতে হবে, তার মানে এই নয় যে-বোকামি বা মিথ্যা কোন কিছুতে নিমজ্জিত হতে হবে। ৪. নিজের সঙ্গে আসার/যোগদান নিমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন পড়ে। কেননা অনেক মানুষ আছে যা সাইড লাইনে বসে নেতার আহ্বানের জন্য অপেক্ষা করে। মহাত্ম গান্ধীর বিখ্যাত উক্তিটি দিয়ে শেষ করব “নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় হলো-অন্যের সেবায় নিজেকে বিলীন করে দেয়া।” (চলবে)
মোঃ বশির আহম্মেদ
একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কর্মী