বিধান চন্দ্র দাস:
নদী হচ্ছে সভ্যতা ও সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। পৃথিবীতে প্রধানত ৯টি নদী—টাইগ্রিস, ইউফ্রেটিস (মেসোপটেমিয়া সভ্যতা), নিল নদ (মিসরীয় সভ্যতা), সিন্ধু (সিন্ধু সভ্যতা), হোয়াংহো, ইয়াংসি (চৈনিক সভ্যতা), ভলগা (রুশ সভ্যতা), সরস্বতী (হরপ্পা সভ্যতা) ও গঙ্গাকে (বৈদিক সভ্যতা) কেন্দ্র করে পৃথিবীর সাতটি অঞ্চলে বিভিন্ন সময় বিকশিত হয়েছিল সভ্যতা। মানুষকে তাদের যাযাবর জীবন ছেড়ে কৃষি জীবনে প্রবেশের জন্য মূল হাতছানি দিয়েছিল নদী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি, পরিবহন, ব্যবসা-বাণিজ্য, শক্তি, শিল্প, মৎস্য, নগরায়ণ ইত্যাদি বিষয় বিকশিত হয়েছিল নদীর মাধ্যমেই। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে নদীর প্রবল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
নদীর বেঁচে থাকার অধিকারকে সম্মান জানাতে হবেপরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য নদী হচ্ছে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। বাস্তুতন্ত্রের জীবনরক্ত। জীববৈচিত্র্যের নিরাপদ আধার।
জলবায়ুর অন্যতম নিয়ন্ত্রক। প্রাকৃতিক ছাঁকনি। কার্বনের আধারও। নদী হচ্ছে পরিবাহক বেল্ট, যা মহাদেশ থেকে সমুদ্রে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত এবং অন্যান্য দ্রব্য সংগ্রহ ও পরিবহন করে।
ভূগর্ভস্থ পানির অন্যতম জোগানদাতা হচ্ছে নদী। খরা ও বন্যার প্রশমনদাতাও। পানি ও পলল পরিবহন প্রক্রিয়ায় গড়ে নেয় তারা তাদের নিজস্ব আকৃতি। সর্পিল কিংবা সোজা। গভীর কিংবা অগভীর।
পৃথিবী নামক গ্রহটির জন্য নদী হচ্ছে জীবনরেখা। কিন্তু সেই জীবনরেখা এখন বিপদাপন্ন। মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডে পৃথিবীর প্রায় সব নদী এখন হুমকির সম্মুখীন। কৃষি, দূষণ, নগরায়ণ, খনি, বাঁধ, পানিপ্রবাহ ভিন্নমুখকরণ, অতি আহরণ, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদির এক বা একাধিক কারণে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি নদী এখন বিপর্যস্ত। লস অ্যাঞ্জেলেস, শিকাগো, কলোরাডো, হার্ডসন (যুক্তরাষ্ট্র), টেমস (যুক্তরাজ্য), দানিয়ুব, রাইন (ইউরোপ), নিল (মিসর), হোয়াংহো, ইয়াংসি (চীন), সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র (ভারতীয় উপমহাদেশ) ইত্যাদি নদী এবং এগুলোর শাখা-প্রশাখাসহ পৃথিবীর প্রায় সব নদী মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ডে বিপদগ্রস্ত।
এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা কাজ করে চলেছে। ২৩ ডিসেম্বর ২০০৩ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২০০৫ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত সময়কে ‘জীবনের জন্য পানি’ শিরোনামে আন্তর্জাতিক কর্ম দশক ঘোষণা করে। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল আমাদের পানিসম্পদের ভালোভাবে যত্ন নেওয়া। এরই সূত্র ধরে কানাডার বিখ্যাত নদী সংরক্ষণবাদী মার্ক অ্যাঞ্জেলো ‘বিশ্ব নদী দিবস’-এর প্রস্তাব করেন। উল্লেখ্য, তাঁরই প্রচেষ্টায় ১৯৮০ সাল থেকে কানাডায় ‘ব্রিটিশ কলাম্বিয়া নদী দিবস’ পালন শুরু হয়। জাতিসংঘ তাদের ঘোষিত ‘জীবনের জন্য পানি’—এই আন্তর্জাতিক কর্ম দশকের মূল সুরের সঙ্গে ‘বিশ্ব নদী দিবস’-এর মিল খুঁজে পাওয়ায় মার্ক অ্যাঞ্জেলো প্রস্তাবিত বিষয়টিকে অনুসমর্থন দেয় এবং ২০০৫ সালে প্রথম ‘বিশ্ব নদী দিবস’ আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হয়। এই দিবসটি প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রবিবার পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ বছর (২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩) এই দিবসের প্রতিপাদ্য করা হয়েছে ‘নদীর অধিকার’।
এ বছরের এই প্রতিপাদ্যে নদীর পরিবেশগত দর্শনকে বিবেচনায় নিয়ে নদী বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চিন্তা করা হয়েছে। নদীর যান্ত্রিক মূল্য বিবেচনার পরিবর্তে তার অন্তর্নিহিত মূল্য বিবেচনায় নেওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে এই প্রতিপাদ্যে। আর সেই কারণেই নদীর অধিকার আছে বিচার চাওয়ার। আইনি কাঠামোর মধ্যেই নদী তার ওপর করা অত্যাচারের বিরুদ্ধে যেন নিজেই বিচারপ্রার্থী। চিৎকার করে সে জানাতে চায়, ‘আমার ওপর করা অত্যাচারের আমি বিচার চাই/আমার প্রবাহে বাধাদানকারীর আমি শাস্তি চাই/আমার বুকে দূষণের বিষ যুক্তকারীদের আমি দণ্ড চাই/আমি চাই আমার বেঁচে থাকার অধিকার।’
নদী তথা নদী বাস্তুতন্ত্র বাঁচানোর জন্য জাতিসংঘের কর্মকাণ্ডসমূহ বহুমাত্রিক। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে—১. টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টের ৬ নম্বর ক্রমিকে ‘সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের টেকসই ব্যবস্থাপনা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা’কে অন্তর্ভুক্তকরণ, ২. পানিসংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক সংস্থার কাজের সমন্বয়ের জন্য ২০০৩ সালে ‘ইউএন ওয়াটার’ প্রতিষ্ঠা, ৩. নদীসহ সব ধরনের জলাভূমি সংরক্ষণ ও তার সম্পদ যুক্তিসংগতভাবে ব্যবহারের জন্য করা ‘রামসার কনভেনশন’, ৪. ইউনেসকো কর্তৃক কিছু নদী ও সংশ্লিষ্ট বাস্তুতন্ত্রকে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ, ৫. বিশ্ব পানি দিবস (প্রতিবছর ২২ মার্চ) পালন, ৬. বিভিন্ন দেশের পানি সংরক্ষণসংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান, ৭. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আইনি সহায়তা এবং এসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরিতে সাহায্যদান, ৮. গবেষণা ও তথ্য সংগ্রহে সাহায্য প্রদান।
অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের নদীগুলোও এখন সংকটাপন্ন। সংখ্যা, আয়তন ও গুণমান—সব দিক থেকেই। একসময়ের প্রমত্তা এবং প্রাণবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ নদী আজ পরিণত হয়েছে প্রায় প্রাণশূন্য সংকীর্ণ স্রোতোধারায় কিংবা বিষাক্ত নর্দমায়। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে অনেক জায়গার অতল জলরাশি ভরা নদী এখন বিস্মৃত। বর্তমানে সেসব অবিস্তীর্ণ অগভীর বালিয়াড়ি ভরা শীর্ণকায় স্রোতঃস্বিনী। দখল আর দূষণে বাংলাদেশের অনেক নদীর অপমৃত্যু ঘটেছে। দেশের অনেক জায়গায় নদী সম্পূর্ণভাবে মুছে দিয়ে তৈরি করা হয়েছে ফসলের ক্ষেত কিংবা স্থাপনা। দেশের অবশিষ্ট নদীগুলোতেও এই প্রক্রিয়া থেমে নেই। নানাভাবে নদীর প্রবাহ বন্ধ করা হচ্ছে। প্লাস্টিক, ঘর-গৃহস্থালির বর্জ্য, কৃষিজমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার এবং কলকারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য নদীর পানিতে মিশে নদীকে করে তুলছে দূষিত।
বাংলাদেশের নদ-নদীর বিপন্ন অবস্থার জন্য বাংলাদেশের আমরাই যে শুধু দায়ী, তা বলা যাবে না। কারণ বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক নদী ভারত (৫৪টি) ও মিয়ানমারের (তিনটি) সঙ্গে সংযুক্ত। হিমালয়ের হিমবাহের আয়তন কমে যাওয়া এবং ভারত কর্তৃক উজানে পানি উঠিয়ে নেওয়ায় (গঙ্গা, তিস্তা) বাংলাদেশের নদীতে পানিসংকট সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যা সমাধানে দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে বাস্তবসম্মতভাবে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের নদীর অবৈধ দখল, পানি ও পরিবেশদূষণ, শিল্প-কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট নদীদূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ ও নানা অনিয়ম রোধকল্পে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ এবং নৌপরিবহনযোগ্য হিসেবে গড়ে তোলাসহ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার প্রয়োজনে ২০১৩ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন তৈরি করা হয়। কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া খসড়া তালিকায় দেশে মোট ৯০৭টি নদীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাপিডিয়ায় এই সংখ্যা ৭০০। কমিশনের ওয়েবসাইটে জেলা ও নদীভিত্তিক অবৈধ দখলদারদের তালিকা দেওয়া হয়েছে। নদীদূষণকারীদের তালিকাসংক্রান্ত সাবমেন্যু রয়েছে (সম্ভবত এটি কাজ করছে না)। বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতায় কমিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য শতভাগ বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জিং, তবে জনগণের সচেতনতা ও অংশগ্রহণে তাৎপর্যপূর্ণ ফলাফল আশা করা যেতে পারে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে নদী বাস্তুতন্ত্র বাঁচানো জটিল ও কঠিন কাজ। নীতিসমূহের সমন্বয়, অনুশীলন, সংশ্লিষ্ট সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয় এখানে জড়িত। কোনো নদীকে বাঁচাতে হলে কয়েকটি ধাপে তা করা প্রয়োজন। এই ধাপগুলো হচ্ছে—১. পরিস্থিতি মূল্যায়ন, ২. দৃঢ় পরিবেশ নীতির বাস্তবায়ন, ৩. সুস্থায়ী ভূমি ব্যবহারে উৎসাহদান, ৪. দূষণ হ্রাসকরণ, ৫. নদীতীরবর্তী অঞ্চল পুনরুদ্ধার, ৬. প্রবাহ বজায় রাখা/ফিরিয়ে আনা, ৭. প্রাকৃতিক উপায়ে (গাছপালা লাগানো) তীর ভাঙন প্রতিরোধ, ৮. সুস্থায়ী মৎস্য আহরণ ও বিনোদন নিশ্চিতকরণ, ৯. জনসচেতনতা বৃদ্ধিকরণ, ১০. আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ, ১১. পর্যবেক্ষণ ও অভিযোজন, ১২. গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ ইত্যদি। নদীকে শুধু জড় বস্তু হিসেবে বিবেচনায় নিলে হবে না। তাকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। বাংলাদেশের হাইকোর্ট ২০১৯ সালে নদীকে ‘লিভিং এনটিটি’ (জীবন্ত সত্তা) হিসেবে ঘোষণা করেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশও তা-ই মনে করে। এবারের বিশ্ব নদী দিবসের প্রতিপাদ্যে নদীর বেঁচে থাকার অধিকার ধ্বনিত হয়েছে। আমাদের তাকে সম্মান জানানো প্রয়োজন।
লেখক : উপাচার্য, নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়