নিজস্ব প্রতিবেদক:
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, কৃচ্ছ্রতা সাধন ও মেগাপ্রকল্পে গুরুত্ব দিয়ে সাজানো হচ্ছে এবারের জাতীয় বাজেট। তবে রাজস্ব আদায় বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের দেয়া বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে। এগুলো মোকাবিলা ও সমন্বয় করে নির্বাচনের বছরে কীভাবে ব্যয় সমন্বয় করা যাবে- তা নিয়ে বাজেটের কাজ প্রায় চূড়ান্ত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আগামী বছরের জন্য চূড়ান্ত করা বাজেটে অনুমোদন দিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করছেন তারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল গুরুত্ব দিতে হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ওপর। সেইসঙ্গে রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর দিকেও নজর দিতে হবে। উচ্চাভিলাষী না হয়ে সংযত বা নিয়ন্ত্রিত বাজেট দিতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা বাড়াতে হবে বলেও জানান তারা। যদিও পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান মনে করেন, আগামী বাজেট হবে উত্তরণের বাজেট। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, যেসব উন্নয়ন হয়েছে সেগুলোকে টেকসই করা দরকার। এবারের বাজেট এক ধরনের ড্রাইভার হিসেবে কাজ করবে।
বাংলাদেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট পেশ হতে যাচ্ছে আগামী ১ জুন। রাষ্ট্রপতি এরই মধ্যে আগামী ৩১ মে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন ডেকেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে ১ জুন জাতীয় সংসদে সরকারের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা
কামাল। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার হবে ১২ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৯ জুন তিনি ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের উপযোগী পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে গত ১০ মে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বাজেটে জোরদার ফিসক্যাল পলিসি গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এদিকে মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্য এডিপিতে সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাচ্ছে পরিবহন খাত। এ খাত পাবে ৭৫ হাজার ৯৪৪ দশমিক ৬২ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ২৮ দশমিক ৮৮ শতাংশ। অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য এ বরাদ্দ ব্যয় করা হবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার নির্বচনী বছরে জনতুষ্টি রক্ষার্থে অবকাঠামো খাতকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যদিও অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রী বাহুল্য ব্যয় পরিহার করে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার উপযোগী বাজেট প্রণয়নের নির্দেশনা আগেই দিয়ে রেখেছেন। তাই নির্বাচনী বছর হলেও জনতুষ্টিমূলক কোনো ব্যয় বাজেটে থাকছে না।
অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত মনে করেন, নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া উচিত। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, প্রধান বিষয় হলো আমরা মূল্যস্ফীতির একটা চাপের মধ্যে আছি এবং এটা সহসা চলে যাচ্ছে না। সুতরাং সরকারি ব্যয়টা একটু নিয়ন্ত্রিত রাখতে হবে। যেসব ব্যয় উৎপাদনমুখী হবে, সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে মূল্যস্ফীতির চাপটা সহনশীল রাখা যায়। তিনি বলেন, এটা নির্বাচনী বছরের বাজেট। তাই সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর যে কর্মসূচিগুলো আছে, সেগুলো আরো জোরদার করতে হবে। এগুলো এমনিতেই দরকার। আর নির্বাচনী বছরে আরো বেশি দরকার। তাছাড়া বিশ্ব অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে আমরা যদি রাজস্ব আয় বাড়াতে না পরি তাহলে আমাদের জন্য অসুবিধা হবে। যেসব প্রকল্পে ব্যয় করে দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে সেগুলোকে আলাদা করতে হবে। তিনি বলেন, রিজার্ভ কিছুটা নেমে গেলেও তাতে খুব প্রভাব পড়বে না; কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়লে নির্বাচনী বছরে সরকারের জন্য খারাপ হবে। এ অর্থনীতিবিদ বলেন, বাজেটে ঘাটতি বেশি ধরা ঠিক হবে না। আমাদের বাজেট ঘাটতি সব সময় জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে থেকেছে, আগামীতেও এটা অতিক্রম করার কোনো কারণ নেই।
আগামী অর্থবছরের (২০২৩-২৪) বাজেট বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণসহ ছয় চ্যালেঞ্জ দেখছে অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। এজন্য খসড়া বাজেটে ব্যয়ের প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরা হয়েছে। জিডিপির অনুপাতে মোট ব্যয় চলতি অর্থবছরের মতো একই থাকছে আগামী দিনেও। অন্যসব চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল রাখা, সুদ ও ভর্তুকি ব্যয়ের টাকার সংস্থান এবং কর ও ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা বাড়ানো। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো ও কর্মসংস্থান সৃজনও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। আইএমএফের ঋণের বিপরীতেই মূলত এ ধরনের একাধিক শর্ত বাস্তবায়ন করতে হবে। এমন পরিস্থিতিতেও উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা করছেন অর্থমন্ত্রী।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনীতির স্বাভাবিক গতির জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের সঞ্চয় ও ক্রয়ক্ষমতা কমছে। অনেকে ঋণ করে চলছেন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেট ঘাটতির অঙ্ক কমাতে হবে। কারণ, বড় ঘাটতির চাপই মূল্যস্ফীতিকে বাড়িয়ে দেয়। এ অর্থনীতিবিদের মতে, আগামী বাজেটে ঘাটতি সংকোচনের পথে যেতে হবে।
জানা গেছে, আগামী দিনগুলোয়ও মূল্যস্ফীতি বহাল থাকবে- এমনটি ধরে নেয়া হয়েছে। ওই হিসাবে আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির হার প্রক্ষেপণ করা হয়েছে ৬ শতাংশ। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি থেকে রক্ষা করতে গরিব মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি বাড়ানো হচ্ছে, সেটিরও ব্যাখ্যা দেয়া হবে। এছাড়া আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ও সুদ খাতে ব্যয় বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করবে। এ ব্যয়ের অর্থ সংস্থান করাই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে অর্থ বিভাগ। ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা এবং ভর্তুকিতে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। যদিও আইএমএফের শর্তে ভর্তুকি কমানোর কথা বলা হয়েছে। তবে ভর্তুকির অঙ্ক বাড়লেও সেটি বকেয়া পরিশোধেই বেশি ব্যয় হবে। আর ভর্তুকি কমাতে আগামী পহেলা সেপ্টেম্বর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় করা হবে। পর্যায়ক্রমে প্রতি তিন মাস অন্তর জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয় অব্যাহত থাকবে। সমন্বয় করা হবে গ্যাস ও বিদ্যুতের দামও। এসব বিষয় সেখানে তুলে ধরা হবে। অর্থ বিভাগের মতে, বিশ্ববাজারে এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে সারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। ফলে এসব খাতে ভর্তুকির চাপ কিছুটা নমনীয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সব ধরনের ভাতা ও ভাতাভোগীর সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। নতুন করে ২৪ লাখ সুবিধাভোগী বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। ফলে এ খাতে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। রিজার্ভ বাড়ানো নিয়ে একটি চ্যালেঞ্জ আছে। কারণ, রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য রেমিট্যান্সে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। আগামী দিনে যদি এসব সূচক ঠিক না হয়, তাহলে অর্থনীতিতে আরো চাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে ডলারের এই সংকট কাটাতে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয় বাড়ানোয় জোর দেয়া হবে। কারণ, ডলারের একটি বড় জোগান আসে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। কিন্তু রেমিট্যান্স থেকে আয় কমছে। এজন্য রেমিট্যান্স বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো একটি অ্যাপ খোলার সিদ্ধান্ত হয়। এই অ্যাপ ব্যবহারের জন্য প্রবাসীদের যাত্রার শুরুতে একটি কার্ড দেয়া হবে। ওই কার্ড ব্যবহার করে যাতে তাৎক্ষণিক অ্যাপের মাধ্যমে একজন প্রবাসী তার পরিবারের কাছে রেমিট্যান্সের অর্থ পাঠাতে পারেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এতে আগামী দিনে রেমিট্যান্স আরো বাড়বে।
আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের উৎস থেকে (এনবিআর কর) ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা, নন-এনবিআর কর ২০ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তি (এনটিআর) ৫০ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে পরিচালনাসহ অন্যান্য ব্যয়ের আকার ৪ লাখ ৯৬ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন প্রকল্প এডিপির আকার ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা। তবে পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতায় যাবে ৭৭ হাজার কোটি, পণ্য ও সেবায় ৪০ হাজার কোটি, ঋণের সুদ পরিশোধে ১ লাখ ২ হাজার ৩৭৬ কোটি, ভর্তুকি প্রণোদনা ও নগদ ঋণ ২ লাখ ৫ হাজার কোটি এবং অন্যান্য খাতে ব্যয় ৭২ হাজার ৫৭৯ কোটি টাকা। আসন্ন বাজেটে সম্ভাব্য ঘাটতির (অনুদান ছাড়া) অঙ্ক দাঁড়াবে ২ লাখ ৫৯ হাজার ৯৫৫ কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৪২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক খাত থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।