নিজস্ব প্রতিবেদক:
জলবায়ু পরিবর্তন, অবকাঠামোর অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন এবং মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে প্রতিবছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নেমে যাচ্ছে। ফলে সামনের দিনগুলোতে একদিকে যেমন সুপেয় পানির ভয়াবহ সংকট সৃষ্টি হবে, অন্যদিকে ভূপৃষ্ঠেরও অপ্রত্যাশিত পরিবর্তন হতে পারে; ঘটতে পারে ভূমিকম্পের মতো বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগও। তাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানো তথা যতটা দ্রুত সম্ভব পানির স্তুর নেমে যাওয়া রোধে নীতিনির্ধারণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পানির স্তর এভাবে নেমে যেতে থাকলে তা আমাদের জাতীয় জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সারাদেশে সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহে কাজ করে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর। দেশব্যাপী নিরাপদ পানি সরবরাহে এ অধিদপ্তরের অনেকগুলো প্রকল্প চলমান রয়েছে। তাদের করা জরিপে উঠে এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত নগরায়ণের কারণে রাজধানী ঢাকা, সাভার, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে ভয়াবহভাবে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এসব এলাকায় প্রতিবছর গড়ে ২ থেকে ৩ মিটার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এতে করে ঢাকা ও এর আশপাশে এক সময় নিরাপদ পানির ভয়াবহ সংকট দেখা দিতে পারে। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আশঙ্কাজনক হারে নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলন। যে পরিমাণ পানি উত্তোলন করা হয়, মাটিতে পানি সংরক্ষণের হার তার তুলনায় খুবই কম। দ্বিতীয়ত, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত বৃষ্টি হওয়ায় মাটির নিচে সংরক্ষিত পানির পরিমাণ কমে গেছে। তৃতীয়ত, নগরায়ণের জন্য নির্মিত অসংখ্য স্থাপনা এবং অতিরিক্ত কংক্রিটের ঢালাইয়ের কারণে তা ভেদ করে পানি ভূগর্ভে প্রবেশ করতে পারছে না। সব মিলিয়ে মাত্রাতিরিক্ত হারে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। ঢাকা মহানগরীকে ১০টি জোনে ভাগ করে পানি সরবরাহ করে ঢাকা ওয়াসা। তাদের সরবরাহকৃত পানির ৬৭ শতাংশ গভীর নলকূপের মাধ্যমে ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হয়। এ জন্য ৯০৬টি গভীর নলকূপ রয়েছে ওয়াসার। অবশিষ্ট ৩৩ শতাংশ পানি আসে ভূ-উপরস্থ উৎস থেকে। ঢাকার পানির স্তর সঙ্গত কারণেই ভয়াবহভাবে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে। কিন্তু সেই তুলনায় শূন্যস্থানে পানি জমছে খুবই কম। ঢাকা ওয়াসার তথ্যমতে, প্রতিবছর ২ থেকে ৩ মিটার করে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। আগে যেখানে ৫০ থেকে ৬০ মিটারের মধ্যে পানি পাওয়া যেত- এখন সেখানে ৮০, ৯০ মিটারে গিয়েও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ভূগর্ভস্থ পানিবিজ্ঞান পরিদপ্তরের পরিচালক (জিওলজি) ড. আনোয়ার জাহিদ বলেন, পানির স্তর নেমে যাওয়ার অন্যতম কারণ ভূগর্ভস্থ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন। যে পারিমাণে পানি উত্তোলন করা হয়, সেই পরিমাণ পানি রিচার্জ হচ্ছে না। আগামী দিনের জন্য এটি এক মারাত্মক ঝুঁকি। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় পানি পাওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, সারাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে, যা বর্ষা মৌসুমে আগের অবস্থায় ফিরছে। কিন্তু দুই-তৃতীয়াংশ এলাকাতেই পানির স্তর নেমে যাওয়ার পর আর আগের অবস্থায় ফিরে আসছে না। এটাই ভয়ের কারণ। বিশ^ব্যাংকের ২০১৯ সালের জরিপে উঠে এসেছে, বাংলাদেশে ৯০ শতাংশ পানি ব্যবহৃত হয় চাষাবাদে, যার সিংহভাগেরই উৎস ভূগর্ভ। গৃহস্থালি ও শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত হয় ১০ শতাংশ পানি। এর মধ্যে পানের জন্য ব্যবহৃত হয় ১ শতাংশ। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী এএইচএম খালেকুর রহমান বলেন, পানির স্তর বেশি নামছে বরেন্দ্র অঞ্চলে, ঢাকা ও এর আশপাশে এবং খরাপ্রবণ এলাকায়। সাধারণত ভূগর্ভের ৮ মিটার গভীরে পানি পাওয়া না গেলে আমরা গভীর নলকূপের পরামর্শ দিই। দেশের বড় একটি অংশে পানির স্তর ভয়াবহভাবে কমছে। বিশেষ করে যেখানে যেখানে নগরায়ণ হচ্ছে সেখানেই পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। এর অন্যতম কারণ নগরায়ণের ফলে পানি নিচে রিচার্জ হওয়ার সুযোগ পায় না। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের তথ্যমতে দেশের বরেন্দ্র এলাকা, খরাপ্রবণ এলাকা, আরবান এলাকা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকটাপন্ন এলাকা, বেড়িবাঁধ এলাকার পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। গবেষকদের ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে- রাজশাহী, রংপুর, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, বগুড়াসহ বরেন্দ্র এলাকার এঁটেল মাটির কারণে সেসব এলাকায় পানি নিচে নামতে পারে না। ফলে পানির সংরক্ষণ কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণেও পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। অন্যদিকে খরাপ্রবণ এলাকাতে এমনিতেই পানির সংকট থাকে সব সময়। ফলে সেসব এলাকার পানির স্তরও নেমে যাচ্ছে।