নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিগত যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চ্যালেঞ্জিং হবে- এমন কথা দলীয় ফোরাম ও সংসদীয় দলের সভায় এমপি ও শীর্ষনেতাদের জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতিও রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটির পক্ষ থেকে। সে জন্য অনেক আগেই দলীয় এমপিদের এলাকামুখী হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন দলীয় প্রধান। সেই সঙ্গে সরকারের উন্নয়ন কাজ ও সাফল্য প্রচারে জোর দোওয়া হয়েছে। তবে অধিকাংশ এমপি এই নির্দেশনা মানছেন না। উল্টো নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলের সুনাম ক্ষুন্ন করছেন। এ অবস্থায় আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোর হচ্ছে দলীয় হাইকমান্ড। আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচ সিটির নির্বাচন নিয়ে তুমুল ব্যস্ততার মধ্যেও আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ চলছে কেন্দ্রে। দলীয় প্রধানের নির্দেশে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের পাশাপাশি দলের বর্তমান এমপিদের আমলনামা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। যেসব জনপ্রতিনিধি এলাকাবিচ্ছিন্ন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে, ত্যাগী নেতাদের দূরে রেখে যারা ব্যক্তিবলয় তৈরি করেছে- তাদের তালিকা তৈরি কাজও শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য এমপিরা আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে বাদ পড়তে পারেন। এ ছাড়া যারা নানা ইস্যুতে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন, তারাও মনোনয়নবঞ্চিত হতে পারেন। নির্বাচনের আট মাস বাকি থাকতে এসব বিষয় ঠিক করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। সূত্রমতে, কোনো কোনো সংসদ সদস্য এলাকায় গেলেও দলীয় নেতাকর্মী বাদ দিয়ে নিজস্ব বলয় নিয়ে চলাফেরা করেন। আওয়ামী লীগকে পাশ কাটিয়ে নিজের পছন্দের লোকদের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেন। এসব এমপির বিরুদ্ধে মুখ খোলা শুরু করেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে দলীয় নেতাকর্মীরা সংবাদ সম্মেলনও করেছেন। কেউ কেউ লিখিত অভিযোগ করছেন দলীয় প্রধানের কাছে। অনেকে গণভবনে এসে সরাসরি নেত্রী শেখ হাসিনার কাছে অভিযোগ তুলে ধরেছেন। এ ছাড়া জলমহাল, সরকারি খাস পুকুর, বাড়িঘর দখলসহ নানা অভিযোগ উঠছে কোনো কোনো এমপির বিরুদ্ধে। আবার নির্বাচনী এলাকায় স্কুল, কলেজসহ হাটবাজারের নিয়ন্ত্রণ এমপিদের আত্মীয়স্বজনের কব্জায় চলে গেছে- এমন অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি নিয়োগবাণিজ্যসহ নানা অভিযোগের স্তূপ জমা পড়ছে কেন্দ্রে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই এমন অভিযোগ বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণভবন সূত্রে জানা গেছে, এলাকাবিমুখ ও বিতর্কিত মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও এমপিদের তালিকা রয়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের হাতে। সারাদেশ থেকে আসা তালিকায় এখন পর্যন্ত পঞ্চাশের বেশি এমপি আগামী নির্বাচনে মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ পড়ার তালিকায় রয়েছেন। জনবিচ্ছিন্নতা, দলের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি, ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অন্য দলের লোকদের ঠাঁই দেওয়াসহ নানা বিতর্কিত কাজে জড়াচ্ছেন তারা।
তালিকায় রয়েছেন বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ও বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুু। তালিকায় রয়েছেন বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথ, যাকে অভিযোগের ভিত্তিতে স্বেচ্ছাসেবক লীগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে স্থানীয় রাজনীতি হত্যা, হামলা ও দলের ভেতরে কোন্দলসহ নানা অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে দল থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ক্ষমা চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সেই অব্যাহতি উঠিয়ে নেওয়া হয়। তবে তার প্রতি দলের হাইকমান্ড ক্ষুব্ধ বলে জানা গেছে।
ঝালকাঠি-১ আসনের সংসদ সদস্য বজলুল হক হারুণ (বিএইএচ হারুণ) নিজের ব্যবসায় ব্যস্ত থাকেন ফলে এলাকায় যোগাযোগ কম। অন্যদিকে বনানীতে রেইন্ট্রি হোটেলে অনাকাঙ্খিত ঘটনার পর এলাকার নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তার দূরত্ব তৈরি হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে। ভোলায়-৪ আসনের এমপি আব্দুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব এলাকার উন্নয়নে অবদান রাখলেও সম্প্রতি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এই আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিনের অনুষ্ঠানে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছে দল। অন্যদিকে ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও ওই আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী ইঞ্জিনিয়ার নোমান হাওলাদারের কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ আছে।
ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিম ও তার ‘বেপোরোয়া’ সন্তানের বিষয়েও ক্ষুব্ধ দল। অন্য দলের নেতাকর্মীদের জায়গা দিয়ে ত্যাগী নেতাদের দূরে রাখা, ব্যক্তিগত জীবনে বিশৃঙ্খল ও বিভিন্ন মানুষের ওপর হামলার অভিযোগ আছে ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য মনিরুল ইসলাম মনুর বিরুদ্ধে। এ ছাড়া স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও তার দূরত্ব রয়েছে বলে জানা গেছে। এ ছাড়া নেত্রকোনার দুইজন এমপি, সুনামগঞ্জের একজন, মাদারীপুরের একজন, চাঁদপুরের একজন, লক্ষ্মীপুরের একজন, ময়মনসিংহের একজন, যশোরের একজন, রংপুরের একজন এমপিসহ পঞ্চাশের অধিক এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছাড়াও দলে পদবাণিজ্যসহ অভিযোগের স্তূপ জমা পড়েছে দলের শীর্ষপর্যায়ে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব এমপি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে দলের রেড তালিকায় নাম উঠিয়েছেন। তাদের বিষয়ে দল এবার কোনোরকম ছাড় দেবে না।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রায় অর্ধেক আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। দলের সর্বশেষ কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলে দিয়েছিলেন যে ১০০টি আসনে প্রার্থীর কথা তিনি ভেবে রেখেছেন। গত ১২ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় দলীয় এমপিদের জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। জনবিচ্ছিন্ন সংসদ সদস্যরা আগামী সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন না বলেও তিনি সতর্ক করেছিলেন।
গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর দলের বর্তমান কমিটির প্রথম সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এর গত ২৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে ৮ বিভাগের বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিমের নেতারা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার হাতে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। সভাপতিমণ্ডলীর বৈঠকে আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ হাসিনা নেতাদের উদ্দেশে বলেন, আমার কাছে অনেকেরই আমলনামা রয়েছে। আপনারাও খোঁজখবর নেন, আমাদের যারা এমপি রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কোথায় কী দোষত্রুটি এবং দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের কী ধরনের অভিযোগ রয়েছে। কারণ আগামী নির্বাচন চ্যালিঞ্জং ইস্যু। বিতর্কিত কাউকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না।
আওয়ামী লীগের আরেক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, সভাপতি আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে গাজীপুর ও বরিশালে বর্তমান মেয়রদের বাদ দিয়ে নতুন দুই মুখকে মনোনয়ন দিয়েছেন। তারা বলছেন, বরিশালের মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ (শেখ হাসিনার ভাতিজা) এবং গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম দলের বদনাম করায় তাদের বাদ দেওয়া হয়েছে। সিটি নির্বাচনের মনোনয়নের মাধ্যমে দলের সভাপতি মূলত কারও মনোনয়নই যে নিশ্চিত নয় এই বার্তা দিতে চেয়েছেন।
আগামী নির্বাচন কেমন হবে এবং দল কেমন প্রার্থী দেবে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কামরুল ইসলাম আমাদের সময়কে বলেন, ‘২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ২০১৮ সালে বিএনপি এক আসনে একাধিক প্রার্থীর নিকট থেকে টাকা নিয়ে বিএনপি একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি করে। ফলে সম্মানজনক হারা থেকেও বঞ্চিত হয়। এবার বিএনপি যত কথাই বলুক, তারা নির্বাচনে আসবে। ফলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। তিনি বলেন, যার এলাকায় সুনাম রয়েছে, জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত, দলীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে- তারাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন।