বেরিয়ে আসছে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় বারাকা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনিয়ম কাহিনি
*ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে পলাতক ফিরোজ
* স্ত্রীকে কারাদণ্ড; ক্লিনিক সিলগালা
সোহানুর রহমান:
নেই প্রাতিষ্ঠানিক সনদ, নেই কোন নিবন্ধন। অথচ বনে গেছেন সব বিষয়ের উপর বিষেশজ্ঞ চিকিৎসক। ভুয়া পরিচয়ের আড়ালে গড়ে তুলেছেন বারাকা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নামে একটি প্রতিষ্ঠান। অহরহ অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা চলছে সেখানে। গত ২ বছর ধরে চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় প্রকাশ্যে এমন অবৈধ কার্যক্রম চললেও চোখে পড়েনি কারও। সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হলে গতকাল মঙ্গলবার অভিযান চালায় দামুড়হুদা উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগ। ভ্রাম্যমাণ আদালতের খবর পেয়ে ক্লিনিক ছেড়ে পালায় পরিচালক ফিরোজ আহমেদ। এসময় তার প্রাতিষ্ঠানিক সনদ যাচাই বাছাই করে পাওয়া যায় চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তবে ফিরোজ আহমেদ অনুপস্থিত থাকায় তাকে দণ্ডিত করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে ক্লিনিকের বিভিন্ন অনিয়মের প্রেক্ষিতে ফিরোজ আহমেদের স্ত্রী ক্লিনিক মালিক শাওন আক্তারকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড ও ক্লিনিক সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২০২১ সালের ৮ আগস্ট দর্শনার পুরাতন বাজারের দোয়েল চত্বরের একটি তিনতলা ভবন ভাড়া নিয়ে চালু হয় বারাকা ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার নামে একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। ক্লিনিকটির পরিচালনায় রয়েছেন ঝিনাইদহের কোর্টচাঁদপুর এলাকার ফিরোজ আহমেদ। ক্লিনিক পরিচালনার পাশাপাশি নিজেকে এমবিবিএস ডাক্তার পরিচয় দিয়ে প্রতিনিয়ত দেখতেন রোগী করতেন অপারেশন। প্রায় ২ বছর ধরে এভাবে নিজেই চিকিৎসা দিয়ে আসছিলেন ফিরোজ আহমেদ। কিন্তু তার প্রেসক্রিপশন ও সাইনবোর্ডে ব্যবহার করা ডিগ্রি নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন ওঠে। তৈরি হয় বিতর্কের। প্রেসক্রিপশনে ফিরোজ আহমেদ নামের আগে ডাক্তার বসিয়ে এমবিবিএস (সিএম), পিজিটি (ইন্টিঃমেডিসিন এন্ড অর্থ), সিসিডি (ডায়াবেটিস), এসভিডি, এসএমইউ (আল্ট্রা), কনসালটেন্ট অব ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন ডিগ্রি ব্যবহার করে হরহামেশাই দিয়ে যাচ্ছিল চিকিৎসা। তার ভিজিট ৩শ টাকা। শুধু বারাকা ক্লিনিকেই নয়, পাশর্^বর্তী কুড়লগাছিতেও রয়েছে তার ব্যক্তিগত চেম্বার। প্রেসক্রিপশনে তার এমন অবাক করা ডিগ্রি দেখে অবাক খোদ বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) চুয়াডাঙ্গা জেলা শাখার সভাপতি চিকিৎসক মার্টিন হীরোক চৌধুরী। তিনি ব্যাখা দিতে গিয়ে বলেন, ‘একজন ব্যক্তির চিকিৎসাশাস্ত্র পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর বাংলাদেশ মেডিকেল এন্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হবে। তবেই সে নামের আগে ডাক্তার লিখতে পারবে এবং প্র্যাকটিস করতে পারবে। কিন্তু ফিরোজ আহমেদ তার প্রেসক্রিপশনে বিএমডিসি’র কোন কোড ব্যবহার করেনি। তিনি এনসিআইএম-বি/পিপিআরসি-১২০৩০ কোড ব্যবহার করেছেন। যা বিএমডিসি কর্তৃক নিবন্ধিত কোন কোড নয়। বরং এখানে প্রমাণিত হয় তিনি আইনের চোখে অবৈধ ও ভুয়া চিকিৎসক।’
বিষয়টি জানাজানি হলে গতকাল মঙ্গলবার দর্শনার বারাকা ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অভিযান চালায় দামুড়হুাদা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সজল কুমার দাস ও দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফারহানা ওয়াহিদ তানি। অভিযানে গিয়ে পাওয়া যায়নি অভিযুক্ত ফিরোজ আহমেদকে। এসময় তার প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র যাচাই বাছাই করে দেখা যায়- তিনি এমবিবিএস ডাক্তার নন। কিন্তু ফিরোজ আহমেদ অনুপস্থিত থাকায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের দলটি। এছাড়া ক্লিনিক ও অপারেশন থিয়েটারে অভিযান চালায় আভিযানিক দলটি। সেখানে পাওয়া যায় মেয়াদোত্তীর্ণ জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ ও ইনজেকশন। যা রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করা হত। ক্লিনিকের নিবন্ধনেও রয়েছে জটিলতা। এসব অভিযোগে বারাকা ক্লিনিকের মালিক ও অভিযুক্ত ফিরোজ আহমেদের স্ত্রী শাওন আক্তারকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক। একইসাথে ওই ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয়া হয়।
দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য ও প.প. কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফারহানা ওয়াহিদ তানি জানান, ফিরোজ আহমেদের প্রাতিষ্ঠানিক সনদপত্র খুঁজে এমবিবিএস কিংবা বিএমডিসির কোন নিবন্ধন পাওয়া যায়নি। তিনি যেহেতু ভ্রাম্যমাণ আদালতের সামনে উপস্থিত ছিলেন না সেহেতু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা যায়নি। কিন্তু তাকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেধে দেয়া হয়েছে। ফিরোজ আহমেদ তার সনদ ও নিবন্ধনপত্র নিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে যোগাযোগ করবেন বলে সাফ জানানো হয়েছে। এর ব্যতয় ঘটলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের বিচারক ও দামুড়হুদা উপহেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) সজল কুমার দাস জানান, ওই ক্লিনিকে দীর্ঘদিন ধরে অপচিকিৎসা চলছিল। তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এর সত্যতা পাওয়া যায়। সনদপত্র ছাড়াই চিকিৎসক পরিচয় দিতেন ক্লিনিকের পরিচালক ফিরোজ আহমেদ। ভ্রাম্যমাণ আদালত আসার খবরে পালিয়ে যান তিনি। তাকে তলব করা হয়েছে। অপরদিকে, ক্লিনিকের বিভিন্ন অভিযোগে তার স্ত্রী ক্লিনিক মালিক শাওন আক্তারকে ১৫ দিনের কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। একইসাথে ক্লিনিকটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছে।