দর্শনা অফিস:
ফরিদপুরের ভাঙ্গায় নূর ইসলাম কুদ্দুস নামের এক শ্রমিককে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যার পর গলায় দড়ি বেঁধে গাছের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা বলে চালানোর অভিযোগ উঠেছে। নিহত কুদ্দুস (৩০) মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনদার উপজেলার বিক্রমপুর বালাসর গ্রামের মৃত মনখুশি মিয়ার ছেলে। বর্তমানে তিনি চুয়াডাঙ্গার দর্শনা পৌর এলাকার পরানপুর বেলেমাঠ পাড়ার বাসিন্দা। গত মঙ্গলবার রাতে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে জানা গেছে।
এদিকে তাবাসসুম এন্টারপ্রাইজের ঠিকাদার তানভির তার সহযোগী সোহেল, রিদয়, পান্নু, রিপনসহ অজ্ঞাত বেশ কয়েকজন সঙ্গবদ্ধ ভাবে এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে তার সহকর্মীদের দাবি। নিহত নূর ইসলাম কুদ্দুসের মৃতদেহ তার নিজ বাড়িতে পৌঁছালে নেমে আসে শোকের ছায়া। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বৃদ্ধা মা পাগল প্রায়। স্ত্রী ও দুই ছোট্ট সন্তান নিয়ে দিশেহারা।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার দর্শনা পৌরসভার পরানপুর বেলে মাঠ পাড়ার মৃত দেলোয়ার হোসেনের ছেলে নূর ইসলাম ওরফে কুদ্দুস গত পাঁচ ছয় মাস আগে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায় রেলওয়ে জংশনে নির্মাণ কাজে যোগ দেয়। এই কাজ চায়না রেল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পেয়ে সাব কন্ট্রাক্ট হিসেবে স্থানীয় তাবাসসুম এন্টারপ্রাইজের তানভীরকে দেন। তানভীর নূর ইসলাম ওরফে কুদ্দুসের একটা সাইডের কিছু কাজের দায়িত্ব দেয়। যার বিল ৪৫ দিন পর পর দেওয়ার কথা থাকলেও ঠিকমতো সেই বিলের টাকা পরিশোধ করে না তানভির। স্থানীয় কর্মীদের অভিযোগ গত ছয় মাসে ১৫/২০ জন শ্রমিকের নূর ইসলাম কুদ্দুসের মাধ্যমে কাজ করালেও তাদেরকে ঠিকমতো বেতন দেয়া হয় না। গত সোমবার শ্রমিকদের বেতন প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা নূর ইসলাম কুদ্দুস চাইলে তার সাথে কথা কাটাকাটি হয়। গত মঙ্গলবার রাতে তানভীর তাকে ডেকে নিয়ে এলাকার বামুন কান্দার একটি পরিত্যাক্ত ঘরের ভিতরে নিয়ে গিয়ে তাকে দলবদ্ধ ভাবে পিটিয়ে ও শ্বাস রোধ করে নির্মম ভাবে হত্যা করে। পরে রাতে তাকে পাশের একটি বাগানে নিয়ে তার গলার সাথে দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখে তারা। পরে খবর পেয়ে গত বুধবার সকালে ঘটনাস্থলে ভাঙ্গা থানার অফিসার্স ইনচার্জ (ওসি) জিয়ারুল ইসলাম সকালে ঘটনাস্থলে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করেন। তারপর ময়না তদন্তের জন্য ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। ময়না তদন্ত শেষে বুধবার রাতে নূর ইসলামের মৃত দেহ তার নিজ বাড়ি দর্শনার পরানপুর বেলেমাঠপাড়ায় পৌঁছায়। লাশ পৌঁছানোর পর এলাকার বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। নেমে আসে শোকের ছাঁয়া। কান্নায় ভেঙে পড়ে তার পরিবারের লোকজন।
তার অবুঝ দুটি শিশু সন্তান জান্নাতুল ও তাসলিমা তার পিতার শেষ আকুতির কথা প্রকাশ করে বলে, আমার আব্বু বলেছিলো আমি হয়তো আর তোমাদের আদর করতে পারবো না। তোমার আম্মুর কথা শুনে চলবা। বাবার এই শেষ আকুতির কথা প্রকাশ করে শিশু সন্তান জান্নাতুল ফিরদউস বলে, আমার আব্বুকে যারা মেরেছে আমরা তার বিচার চাই।
নিহতর মা বলেন, আমার একটামাত্র ছেলে যখন বললো তার সাথে কাজ করছে যারা তাদের টাকা দিতে না পারায় তার মহাজনের কাছে পাওনা টাকা চাইলে হুমকি দিচ্ছে। তখন আমি বলেছিলাম বাবা তোর টাকা যদি ওরা না দেয় তো তুই চলে আয় আমি বাড়ি বক্রি করে তোর দেনার টাকা পরিশোধ করবো। কিন্তু ওই খুনিরা আমার ছেলেকে সেই সুযোগ দিলো না। আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই।
তার স্ত্রী বলেন, স্বামীর মৃত্যুর আগে ফোনে শেষ কথা বলেছিলো, তুমি আমাকে মাফ করে দাও। আমার হয়তো আর বাড়িতে যেয়ে দেখা হবে না। আমি হয়তো আর বাঁচবো না। আর মেয়েদের খেয়াল রেখো তুমি। আমাকে ওরা আর বাঁচতে দেবে না। আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে আমি সেই হত্যাকারীদের বিচার চাই।
তার সহকর্মীরা বলেন, তাবাসসুম এন্টারপ্রাইজের তানভীর সাব কন্ট্রাক্টে নূর ইসলাম ওরফে কুদ্দুসের একটা সাইডের কিছু কাজের দায়িত্ব দেয়। যার বিল ৪৫ দিন পর পর দেওয়ার কথা থাকলেও ঠিকমতো সেই বিলের টাকা পরিশোধ করে না তানভির। এদিকে স্থানীয় ১৫/২০ জন শ্রমিকের কাজের টাকা বাকি হয়ে গেলে তারা টাকার জন্য নূর ইসলাম কুদ্দুসের কাছে টাকা চাই। তখন কুদ্দুসও তানভিরের কাছে টাকা চাই। এর আগেও এই বাকি টাকা চাওয়াকে কেন্দ্র করে কুদ্দুসের সাথে তানভির সহ তার লোকজনের সাথে বাকবিতন্ডা হয়। তখন কুদ্দুস তার পাওনা টাকা নিয়ে কাজ ছেড়ে একবারে বাড়িতে চলে যাওয়ার কথা বলে। তখন তানভির ও তার দলবল বলে তোর এখান থেকে যাওয়া হবে না। এখান থেকে যাওয়ার কথা বল্লে তোর কিডনি বের করে নেবো। এরপর আবার কাজ করালেও তাদেরকে ঠিকমতো বেতন দেয়া হয় না। গত সোমবার শ্রমিকদের বেতন প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা নূর ইসলাম কুদ্দুস চাইলে তার সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এরপর রাতে কৌশলে কুদ্দুসকে একা কাজের কথা বলে ডেকে নিয়ে যেয়ে মাফুজের আন্ডারগ্রাউন্ড ঘরে তানভির তার দলবল নিয়ে নূর ইসলাম কুদ্দুস কে নির্মম ভাবে হত্যা করে তারপর পাশের একটি বাগানে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখে যেন এটা আত্মহত্যা বলে মনে হয়। কিন্তু তার শরীরের ক্ষত চিহ্ন দেখে এবং মাটিতে পা আর পায়ের নিচের পাতা পর্যন্ত সরেনি এসব দেখেই বোঝা যায় যে এটা একদম পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। আর স্থানীয় অনেকেই এ বিষয়ে মোটামুটি জানেন। এটার আইনি সঠিক তদন্ত করলে সব সত্য উদঘাটন হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে ভাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জিয়ারুল বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। অভিযুক্তরা পালিয়ে রয়েছে। ফরিদপুর জেলা পুলিশ সুপার শাহজাহান (পিপিএম) বলেন, ভাঙ্গায় যে হত্যাকান্ড ঘটেছে তার ময়নাতদন্ত হয়েছে। আসামিদের আইনের আওতায় আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।